Monday, December 16, 2019

অমর মিত্র



                                               


                                           কুয়াশা

     [ প্রকাশিতব্য ‘মোমেনশাহী উপাখ্যান’ উপন্যাসে কুয়াশাই প্রধান চরিত্র। কুয়াশাই নিয়ন্ত্রণ করেছে সব চরিত্রের ভূত-ভবিষ্যত। তার সামান্য অংশ এখানে রয়েছে।]  
   
      কুয়াশার সমুখে কুয়াশার কথা হচ্ছিল। বিপুল জিজ্ঞেস করে, আপনি পাহাড়ে কুয়াশা দেখেছিলেন ?
      অতীন বললেন, হ্যাঁ, আমি পাহাড়ে  ক্রমশ প্রলম্বিত  কুয়াশার জন্ম দেখেছি  মশায়, সেদিন রোদ ছিল না বটে, কিন্তু আলো ছিল, সব দিক দেখা যাচ্ছিল, আমি একা একা  পাহাড়ি পথে  চলেছি, আমার ইচ্ছে গারো রাজার দুর্গ দেখব, পাহাড়ে পৌঁছবার আগে পথে  এক বুড়ার সঙ্গে দেখা, সে বলল, যদি আমার যদি ইচ্ছে হয়, আমি নিজেই পথ খুঁজে পাব, পাহাড়ে পথে  রাজার পথ সব পথ, কেউ না কেউ এসে নিয়ে যাবে, কিংবা নিজেই চিনে নিতে পারব, আমি পাহাড়ি পথ ধরে পাহাড়ের ভিতরে প্রবেশ করেছি, কিন্তু কেউ ছিল না কোথাও, বনের ভিতর অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল।
    কেমন ছিল সেই পথ ?  পাথর আর মাটির সেই পথ ঘুরে ঘুরে অনেক উপরে উঠে গেছে। গাছের পরে গাছ। শাল, সেগুন, মহুয়া, গজারী, আকাশমণি, বাঁশ, বেত। শাল, সেগুন, মহুয়ার পাতা ঝরতে আরম্ভ করেছে। জঙ্গলের  নিষ্পত্র হওয়া আরম্ভ তখন। অনেক পাতা আছে অনেক পাতা নেই। পাতা ঝরছে, ঝরেই যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে অনেক দূর। পাহাড়ে পাখির ডাক ছিল। পাতা ঝরার শব্দ ছিল। কার্তিকের শেষের  শীত ছিল ঝিমঝিমে।  অতীন নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন বনে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা কম, তাই। কিন্তু কেমন যেন মনে হচ্ছিল, কোন পথে যাবেন বুঝতে পারছিলেন না। একটা জলাশয় পড়ল পথে। হ্রদ। সেই হ্রদে প্রচুর পদ্ম ফুটেছিল। অতীন একটি পদ্ম সংগ্রহ করলেন। তারপর  চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলেন। পঁচাত্তর বছর আগে গারো পাহাড়ে ভূমিকম্প হয়েছিল তা জানা ছিল তাঁর। সেই ভূমিকম্পে একটা পাহাড় অদৃশ্য হয়ে গিয়ে হ্রদের জন্ম দিয়েছিল। সেই রেবরং লেকের কাছে এসে পৌঁছলেন নাকি ?  আবার হাঁটা শুরু করলেন। জনমনিষ্যি নেই। কাঠুরেরা নেই যে পথ জিজ্ঞেস করে নেবেন।  ধীরে ধীরে নিস্তব্ধতা বেড়ে যাচ্ছিল। অত উপরে পাখিরা ছিল না। পাখির ডাক থেমে গিয়েছিল। তখন তিনি টের পেলেন অনেক উপরে উঠে এসেছেন। সেই সময় অবাক হয়ে দেখতে পান সামনে কুয়াশা জমে আছে। বনের ভিতর থেকে কুয়াশা যেন ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। কুয়াশার রঙ মেঘের মতো। মেঘের রঙ হাতির মতো।কুয়াশা ছেয়ে ফেলতে লাগল বন। এতটা সময় সব দিক ছিল স্পষ্ট। এবার সব অস্পষ্ট হয়ে যেতে লাগল। তাঁকে ঢেকে ফেলল কুয়াশা। কুয়াশায় না প্রবেশ করে তাঁর উপায় ছিল না। কুয়াশার ভিতরে হাঁটতে লাগলেন তিনি অন্ধের মতো প্রায়। কত সময় হেঁটেছেন হিশেব নেই। তারপর আচমকা কুয়াশা নেই। স্তিমিত আলোয় দেখা গেল গারোরাজার দুর্গ। অতি বৃহৎ প্রাসাদ। কুয়াশা ঘেরা দেওয়াল,  লম্বায় অনেক। মনে হলো এক অতিকায়  মানুষ দুদিকে দীর্ঘ দু-হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে।সেই মানুষের মুখ দুর্গের মুখ। সেই মুখে ঝিম ধরা নীরবতা। অতীন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন। কুয়াশা ছিল না, আলো ছিল গোধুলীবেলার মতো। ছায়া ছায়া আলো বনের বাইরে বিস্তৃত। বন আছে দুর্গের পিছনে। বন আছে অনেকটা দূরে। বন যেন দুর্গটিকে ঘিরে ছিল। অতীন ঘুরে তাকালেন অনেক দূরে, যে পথে এসেছেন তিনি। মনে হলো সেই পথে আবার ফিরে যান। আবার মনে হলো ফিরে যাওয়া মানে এই আসা আর আসা হলো না। তিনি আকাশে তাকালেন। নীল, কত নীল তা তিনি বর্ণনা করতে পারবেন না।  অতীন বুঝতে পারলেন, গারো রাজার দুর্গে এসেছেন তিনি। প্রবেশ করতে হবে।
          দুর্গ , হ্যাঁ, দুর্গ। আমি এক দুর্গের সমুখে দাঁড়িয়ে ছিলাম। পাথর আর কাঠ দিয়ে নির্মাণ করা সেই দুর্গের গড়ন ছিল পুব দেশের প্যাগোডার মতো। কাঠের লম্বা বারান্দা। কাঠের কারুকাজ তাকিয়ে দেখার মতো। লতা পাতা, সাপ, ড্রাগন,  মেঘের স্তূপ, কত রকম অলঙ্করণ ছিল। রাজার বাড়ির জানালা দরজা খোলা ছিল। আমি সম্মোহিতের মতো প্রবেশ করলাম ধূসর দরজা দিয়ে। এখন মনে হয়, কুয়াশার ভিতর লুকিয়ে থাকে যে বাড়ি, তার দরজাও ছিল কুয়াশার পর্দা। তখন সেই পর্দা সরে গেছে। বুঝতে পারলাম কুয়াশার ধূসরতা ছিল দুর্গের প্রাচীর।  লম্বা এক পথ ছিল আমার সমুখে। সেই পথ আমাকে নিয়ে গেল রাজ দরবারে। দরবার খুব সাধারণ। একটি শূন্য আসন ব্যতীত ঘরে কিছুই ছিল না বলতে গেলে। আরো বলা যায় শূন্যতা ব্যতীত সেই ঘরে কিছুই ছিল না। মনে হচ্ছিল মহাশূন্যের ভিতরে প্রবেশ করেছি। প্রাসাদ আসলে নেই। মাথার উপরে কুয়াশার যে ছাদ, তার উপরে আকাশমন্ডল। চারপাশের দেওয়াল তো কুয়াশার আবরণ। সেই মহাশূন্যতার ভিতর  অতিবৃদ্ধ  এক গারো পুরুষ বসে ছিলেন লম্বা কুশনে। তাঁর দিকে তাকালেও  মনে হয় ঘর নেই, প্রাসাদ নেই, আছেন তিনি পরম শূন্যতায় একা একা।  তিনি কেমন ? অনতিউচ্চ এক বৃদ্ধ যাঁর কপাল অজস্র বলিরেখায় ভরা। বৃদ্ধ গাছের গায়ে যেমন বয়সের চিহ্ন ফোটে রেখায় রেখায়,  তেমনি। তাঁর গায়ে ছিল লাল, নীল, রঙিন আলোয়ান। পরনেও ছিল নীল পোশাক। মাথায় ছিল পাতার মুকুট। মুখখানিতে হাসি। আমার মনে হলো মানুষ নয়, এক বহুবর্ণ ফুল-পাতায় ভরা অচেনা বৃক্ষ।  তিনি আমাকে দেখে অবাক, বললেন, ময় ত আসিতে কহি নাই, তুমু কেডা হইস, এহেনে কাউর তো আসার কথা ছিল না ?
      আমি বললাম, আমি যে শুনলাম রাজার ডাক এসেছে।
      গারো রাজা বললেন, যাই হক আইসো, ভালো করিস, তুমু মোর পজা ?
      জ্বি , পজা।
      কেনে আইসো ?
      খান সেনা আসতেসে, গণ হত্যা হবে।
      হারায়ে যাবে কুয়াশায়। তিনি বললেন। হাসলেন আমার দিকে চেয়ে। সেই হাসি আমি ইহ জন্মে ভুলব না। চোখদুটি  প্রস্ফুটিত শাদা আলোর দুই বিন্দু, যেন মহাশূন্যের দুই তারা, দুই তারা যেন চেয়ে আছে পরস্পরের দিকে।আপনি ভাবুন একটি চোখ অন্য চোখের দিকে তাকিয়ে। এক চোখ অন্য চোখের দিকে চেয়ে হাসল।  সেই হাসি তখন আমার গায়ে ছড়িয়ে যেতে লাগল  হিম কিংবা বৃষ্টির ফোঁটার  মতো। তিনি হাত  তুলে ইঙ্গিতে আমাকে আসন নিতে বললেন।আমি একটি নিচু আসনে বসেছি। তিনি ব্যগ্র কন্ঠে  জিজ্ঞেস করলেন, সোমেশ্বর রাজা সন্ধি করতে পাঠাল, ময় জানি  একদিন কেউ আসব সোমেশ্বর পাঠকর  পস্তাব নিয়া, মোর শকতি সে বুঝি পারিসে।      
    জ্বি ! আমি বুঝতে পারলাম না।
    মুর  হস্তিবাহিনী  তখন প্রস্তুত ছিল না। বললেন গারো রাজা, হস্তিযূথ প্রস্তুত থাকলে সোমেশ্বর পাঠক পরাস্ত হয়ে ফিরে যেত কান্বকুব্জের পথে ।
    শোনা যায়, সোমেশ্বর পাঠক পরাস্ত করেছিলেন গারো রাজাকে।
    তিনি হাসলেন, মোর শকতির নিকট সে তুচ্ছ, মুই এখন বুঝি, এতকাল ধরে ময় রহি গিসি এই স্থলে, একা, ময় একা?
   আমি ঝুঁকে বললাম, একা কেন, রাজায় কি একা থাকে ?
  রাজায় একা থাকে, রাজায় পারে একা থাকতে, রাজার কেহ নাই, জন-মনিষ্যি নাই, রাজা জানে  তার নিজের কত শক্তি,  মহাশূন্যে একা থাকে তারারা, একা থাকার শক্তি আছে বলে পারে, নইলে ভয়ে তারা আকাশ ছেড়ে পলাত, আকাশ অন্ধকার হয়ে যেত,  তুমাদের ঐ  সোমেশ্বর পাঠকের লোক-লস্কর লাগে, মোর লাগে না, মুই একাই এত শত বছর রয়ে গেসি,
   আঁজ্ঞে, তিনি তো বেঁচে নেই। আমি বললাম, বহু শত বছর আগে গত হয়েছেন।
   নেই! প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন বৃদ্ধ, বিড়বিড় করতে লাগলেন,  ময় রইসি, সে নাই, আহা, আমি  সর্বত্যাগী রাজা, পাঠকেরে আমি রাজ্য দিয়া বসে আছি এই প্রাসাদে,  মুই তাতারা রাবুগার আশীব্বাদ পাইসি,  তিনি মুদের বড় ঠাকুর, তাতারা রাবুগা কইসেন তাই ময়  রাজা গোয়েরা মুর শোক  নিবেদন করলাম, তাইই কইসি ময়। বলতে বলতে বৃদ্ধ রাজা তাঁর চীবরের মতো গাত্র বস্ত্র দিয়ে চোখ মুছলেন, ময়  তো  হিংসা করিনাই,  ময়  নিজেও মেনে নিয়েসিলাম পরাজয়, সে দুর্গ অবধি না এসে নিচে নেমে গেল, হায় তার সঙ্গে আর দেখা হবে না ?  
          আমি বললাম, সাতশো বছর আগে তিনি এদেশে এসেছিলেন।
          সাতশো বছর! সেদিনের ব্যাপার, সে কার হাতে মরিসে ? গারো রাজা গোয়েরা  জিজ্ঞেস করলেন, পাকিস্তানি খান সেনা ?
          না,তিনি  বহুদিন আগে ছিলেন তিনি, বহুদিন আগে চলে গেছেন। আমি বললাম।
          তুমি তারে মরতি দেখিস ? গারো রাজা জিজ্ঞেস করলেন।
          না, আমি দেখব কী করে, আমার বয়ঃক্রম একবিংশতি মাত্তর।
          তবে যে বললে সে মরি গিইসে, মরিতে তুমু দেখ নাই  ?
          আমি বললাম, এত দিন কেউ বাঁচে না।
          ময়  কি বাঁচি নাই, ময়  কি মরি গিইসি ? জিজ্ঞেস করলেন বৃদ্ধ রাজা। অতীন চুপ করে থাকলেন।
          সোমেশ্বর পাঠক কি বানপ্রস্থে গিইসেন, এই পাহাড়ের দিকে চলা আইসেন ? বৃদ্ধ রাজা জিজ্ঞেস করলেন।
          অতীন বললেন, তাঁর জানা নেই। বলতে বলতে  মাথা নত করলেন। কেন না তিনি দেখছিলেন পরাস্ত রাজা বিজয়ী রাজার মৃত্যু সংবাদে শোকার্ত হয়েছেন। তাঁর ছিল মুন্ডিত মস্তক। গাত্র বস্ত্র গভীর কালচে লাল, মুখমন্ডলেও  অজস্র বলিরেখা, চক্ষুমণি জ্বলজ্বল করছে জলের ভিতর ঝাঁকের মাছের এক একটির  মতো।
        রাজা বললেন, হে সিমসাং নদী, আমার শোক  লইয়া যাও।  
         অতীন মোহমুগ্ধের মতো বললেন, শোক গ্রহণ করতা আমার আসা।
        হে বনর বাতাস, মোর দুঃখ নিয়া যাও। রাজা নিচু হয়ে বললেন।
        অতীন বললেন, আমি সব কথা জানাব।
          রাজা বললেন, মু একা মান্দি ( মানুষ), আমি কারে দিয়ে পাঠাব শোকবার্তা, হস্তিযূথে ডর লাগব মান্দিগনের।
          তিনি নেই। সোমেশ্বর সিংহের কথা আবার স্মরণ করালেন অতীন। 
         শোকের কথা কইসি বটে, কিন্তু  বিশ্বাস করি না, রাজা নাই মোর বিশ্বাস হয় না, এখন যুদ্ধ চলতেছে, খান সেনা যদি মুর রাজ্যে ঢুকে, ময় শেষ করি দিব হাতি পাঠায়ে, কুয়াশায় ঘিরে দিয়ে, কুয়াশা নামায়ে দিব জগতে।
          বিপুল বলল, এসেছিল তাহলে খান সেনা ?
          অতীন বললেন,  জানা নেই।
          বিপুল বলল, অস্থিরচন্দ্র বলল যে।
         জানিনে, আমারে গারো রাজা বললেন,  যা তা হলো  একবার আয়ুব খাঁর আমলে, আর্মি আসছে এই খবর পেয়ে  তিনিই হস্তিযূথ পাঠালেন সুসঙ্গতে।তিনি জানতেন আর্মি আসা মানে মানুষের সব্বোনাশ, অন্তত সেই আমলে,  রাজা তা-ই বিশ্বাস করেন, সোমেশ্বর পাঠক জয় করলেও রাজ্য আসলে তাঁর। সোমেশ্বর পাঠক তাঁর অধীনেই রাজা হয়ে আছেন। তাঁর অধিকার সাময়িক। প্রজা পালনে তাঁর নিজের অধিকার। প্রজার ভালো  মন্দে তিনিই তাদের দেখবেন। বিপদে রক্ষা করবেন।তিনি বললেন, খান সেনা আসার খবর তিনি পেয়েছিলেন বনের ্পঙ্খীর কাছে। বনের পঙ্খীরা পাহাড় থেকে উড়ে যায়, খবর নিয়ে আসে। সেই এক  পঙ্খী নাকি হলুদ পঙ্খী। হলুদ পঙ্খী খবর দিলে  তিনি  কুয়াশা নামিয়ে হস্তিসেনা পাঠিয়ে আয়ুবের  সেনাদের পরাস্ত করেছিলেন।    
     আপনি কোনো নারীকে দেখেননি সেখানে ? বিপুল জিজ্ঞেস করল।
     অতীন বললেন, না তিনিই একা, আর কেউ ছিল না, এক আশ্চর্য গোধুলিবেলায় তিনি বসেছিলেন। জানালা ছিল সেই ঘরে। বড় বড় দুটি। কিন্তু মনে হচ্ছিল জানালা, দেওয়াল কিছুই নেই যেন, বাইরে ঘন কুয়াশা,  কুয়াশার পারে কী ছিল তা দেখা যাচ্ছিল না। গারো রাজা বলছিলেন, আবার কুয়াশা নামিয়ে দিয়েছেন সুসঙ্গ থেকে পূর্ব ধলা, নেত্রকোনা পর্যন্ত, সমস্ত জায়গা ছেয়ে আছে নীরন্ধ্র কুয়াশায়, সেনা বাহিনীর সাধ্য কি সেই কুয়াশা ভেদ করে, সেনা বাহিনী  ফিরে যাবে, ভয় নেই। হাত তুলে অভয় দিলেন তিনি।
    এখন প্রতিদিন  কুয়াশা নামছে  কেন ? বিপুল জিজ্ঞেস করে।
   হয়তো এমন কিছু ঘটবে, ঘটতে পারে, তা ঘটতে পারছে না। অতীন বিড়বিড় করলেন, বড় বিপদ থেকে রক্ষা পেয়ে যাচ্ছে সুসঙ্গ দুর্গাপুর কিংবা  এর মানুষজন।
     আমার এখন মনে হচ্ছে প্রবুদ্ধ সুবুদ্ধ আসেনি, তাকে দ্যাখেনি গোপাল দাসও, সবই আপনার উপাখ্যানের কথা। 
     তারা তো পান্ডুলিপিতে আছে। বললেন অতীন, পাণ্ডুলিপি বলবে সব কথা। অতীন চুপ করে থাকলেন।  বিপুল ভাবছিল পান্ডুলিপিই সত্য। সুধীন্দ্র সোমের  পাণ্ডুলিপি ক্রমাগত দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। সুধীন্দ্র  যতটা ভেবেছিলেন তার চেয়ে অনেক বেশি কথা এসে প্রবেশ করছে। দশ হাজার হয়ে যাচ্ছে এক লক্ষ। বিপুলের মনে হয়, সে যা খুঁজতে এসেছিল তার অনেক বেশি পেয়ে গেছে যেন। আরো আছে। মানুষের অদম্যতার কাহিনি শেষ হয় না।  কুয়াশার ভিতর থেকে তা ক্রমাগত বেরিয়ে আসতে থাকে। এই যে কুয়াশা, এর ফলে যে লোকটি ছুরি হাতে বেরিয়েছিল কারোর রক্ত দেখার নেশায়, যে ঘাতক ভেবেছিল শেষ করে দেবে নিরীহ পরিবারটিকে, যে শয়তান ভেবেছিল লুট করে আনবে যুবতিকে, সে কুয়াশায় ঘুরছে, পৌঁছতে পারছে না।  ঘাতকেরা  পথ হারিয়েছে। কত মৃত্যু দুয়ার থেকে ফিরে গেল।
    
                                                      #                       #  
     এবার সেই দিনের অন্য এক ঘটনার কথা বলি। এক  ব্যক্তির কথা বলি। এক   ব্যক্তি আসছিল পাহাড়ি পথে। হাঁটতে হাঁটতে  আচমকা দেখল কুয়াশা নেমে এল। দুর্ভেদ্য কুয়াশা। এক হাত দূরের কিছু দেখা যায় না। সে জানত এমনি হবে। এমনি হয়।  কুয়াশার ভিতরেই আত্মরক্ষা করেন  গারো  রাজা। কুয়াশার প্রাচীরের ভিতরই রয়েছে রাজার বাড়ি। গারো পাহাড় আর সিমসাং নদীর রাজার বাড়ি যাচ্ছে সে ।  সে অন্ধের মতো চলতে লাগল। গারো পাহাড়ে এক রাজার প্রাসাদ আছে, সে তাদের দেখতে এসেছে। দেখে ফিরে যাবে, আর কিছু না। মানুষ এমনি কত কিছু দেখে ফিরে যায়, সমুদ্র, হ্রদ, নদী, পাহাড়, জঙ্গল, সূর্যাস্ত, সূর্যোদয়, কত কিছু। এমনিই দেখে ফিরে যায়। সেও এমনি দেখে ফিরে যাবে কি যাবে না, তা পরের সিদ্ধান্ত। আর কিছু না। এই যে এত কুয়াশা, এমনি কুয়াশা এল কোথা থেকে, সে শুনেছিল, কুয়াশা পেরিয়ে যেতে হবে রাজার বাড়ি। কত পথ যেতে হবে, কত দূর তা জানে না লোকটি। সে নিজের মতোই চলছিল। ভুল না ঠিক পথ জানে না। কিন্তু যেতে যেতে তার মনে হলো কুয়াশার ভিতরে কেউ তাকে দেখতে পাচ্ছে। সে ডাক দিল, কেউ আছ, আমি রাজার বাড়ি যাব, কোন পথে যাব ?
     হলুদ পাখি খবরিয়া ছিল এক শাল গাছের ডালে, বলল, যে পথে যাও, রাজার বাড়ি পৌঁছবে।
    কোন পথে তাড়াতাড়ি পৌঁছব ?
    খবরিয়া পাখি  বলল, যে পথে যাও, একই দূর।
     রাজার বাড়ি উত্তরে না দক্ষিণে, পুবে না পশ্চিমে ?
    উত্তর দিক দিয়ে যাওয়া যায়, পুব দিক দিয়েও যেতে পার, পশ্চিমে রাজার বাড়ি আবার দক্ষিণেও সেই একই বাড়ি, গারো পাহাড় আর  সিমসাং নদীর  রাজা তোমার জন্য  বসে আছে ধামা ভরা ফল-পাকুড় আর গজা,  কদমা নিয়ে।  হলুদ পঙ্খী বলল।
     লোকটা নিশ্চিন্ত হয়। এমনিই শুনেছিল বটে। সে জিজ্ঞেস করল, আর কত সময় লাগবে ?
     হলুদ পঙ্খী বলল, সময় কী তা তো জানি না, তুমি ঠিক পৌঁছে যাবে।
    লোকটি অনেক লম্বা, স্বাস্থ্যবান,গৌরবর্ণ, সে চলল কুয়াশার ভিতরে। চলতে চলতে চলতে, আচমকা দেখল কুয়াশা নেই। বিকেলের আলো যেন মুছে যেতে যেতেও রয়ে গেছে। রোদ নেই। আলোর ভিতরে সূর্যাস্তের লালচে ভাব।
    তখন গারো রাজার সমুখে বসে অতীনের  মনে হচ্ছিল রাজার বাড়ি নয়, এক বিভ্রমবাড়ি এসে পড়েছেন তিনি। তিনি স্পষ্ট ্দেখলেন, কুয়াশার প্রাচীর ভেদ করে এক রাজপুরুষ প্রবেশ করল রাজার বাড়ি। এঁকে তিনি বনের ভিতরে দেখেছিলেন।  তাঁর সমুখে অনেক দূরে হেঁটে চলেছিলেন তিনি। তিনিই রাজা সোমেশ্বর পাঠক। সোমেশ্বর সিংহ। আকাশের এক তারা। 
   কুয়াশার দরজা ভেদ করে লোকটা পৌঁছে গেল। রাজা্র সমুখে অতিথির জন্য একটি আসন। আসনের সামনে পানীয় জল, মিষ্টান্ন। রাজা তাকিয়ে আছেন অতিথির মুখের দিকে। অতিথিও রাজার দিকে চেয়ে আছেন।
   রাজা বিস্মিত গলায় বললেন, তুমি ?
   হ্যাঁ আমি। লোকটি বলল।
   তুমি কি এই প্রাসাদ অধিকার করবে ? রাজা অকম্পিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন।
   লোকটা মাথা নিচু করল, বলল, আমি সব ফেরত দিতে এসেছি রাজা।
   তুমি সোমেশ্বর পাঠক !
   হ্যাঁ মশায়, রাজা।
   রাজা জিজ্ঞেস করলেন, কী ফেরত দেবে ?
   যে রাজ্য জয় করেছিলাম, সেই রাজ্য। বলে দীর্ঘদেহী সেই রাজপুরুষ দুহাত বাড়িয়ে দিলেন। 
   রাজা বললেন, আমাকে কোন রাজ্য ফেরত দেবে, রাজ্য তো আমার আছে।
   আছে ! বিস্মিত হলেন রাজা সোমেশ্বর পাঠক।
   আছে, আমার রাজ্য তো আমারই আছে, কিছুই তুমি নিতে পারোনি।
   সোমেশ্বর পাঠকের চোখে জল এসে গেল, বললেন, তাই বলছ রাজা ?
   হ্যাঁ, আমার কিছুই যায়নি রাজা, তুমি কী দেবে ?
   সোমেশ্বর উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেলেন গারো রাজার দিকে। গারো রাজা, সিমসাং নদীর রাজা উঠে এগিয়ে এলেন। আলিঙ্গন করলেন তাঁরা পরস্পরে।  আর তখনই অন্ধকার নেমে এল। সূর্যাস্ত হলো। প্রাসাদ আর রাজা  সব মুছে গেল জগত থেকে। দেখল সব সেই হলুদ পঙ্খী খবরিয়া । সে উড়ে গেল এই কাহিনি নিয়ে। রাজার বাড়ি নেই। দুই রাজা আর নেই। কুয়াশা আর নেই। আমি পাহাড় থেকে ফিরে এলাম। হ্যাঁ, সেই হলুদ পঙ্খী আর আমার সামনেই যেন সব ঘটেছিল। অথবা সমস্তটাই এই পান্ডুলিপিতে লেখা ছিল। পাণ্ডুলিপি থেকেই তো আমি শোনাচ্ছি এই কাহিনি। 
 

No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না  যে পিতা সন্তানের লাশ সনাক্ত করতে ভয় পায় আমি তাকে ঘৃণা করি- যে ভাই এখনও নির্লজ্জ স্বাভাবিক হ...

পাঠক-প্রিয়