Thursday, December 12, 2019

গদ্য- পার্থজিৎ চন্দ




গান-শোনা জীবনের হিমে

এই ছায়াপথেই তো আমার জন্ম
এই ছায়াপথেই তো জন্মে ছিলেন, গান বেঁধেছিলেন রবীন্দ্রনাথ
            শুধু এই সমাপতন, বাংলা ভাষায় তাঁর গান শোনার পুণ্যে আমিও নিশ্চয় চিরজীবী তাঁর গানের হাত ধরে আমিও নিশ্চয় ছায়াপথের সব থেকে রহস্যময় ও আলোকিত অংশে প্রবেশ করি
            খুব অল্প সময়; অকল্পনীয়ভাবে কম সে সময়; পৃথিবীর কোনও ঘড়ির ক্ষমতা নেই সে সময়কে পরিমাপ করবারআমি সেখানে অধিষ্ঠান করি রবীন্দ্রনাথের গান আমাকে হয়তো পাঁচ-ছয়-সাত মাত্রার কোনও এক জগতে নিয়ে যায় কিন্তু যেহেতু সে কবজকুণ্ডল আমার সহজাত নয়, তাই আমাকে বারবার ফিরে ফিরে আসতে হয়
            আজকাল আমার চোখের সামনে থেকে সরে যেতে শুরু করে এক-একটা ফ্রেম তেমনই একটা ফ্রেমএকটা সিল্যুয়েট লেগে থাকে আমার চোখে এই ছায়াপথ পেরিয়ে যে স্পেসসেখানে ছড়িয়ে রয়েছে কুয়াশা আর হিমের এক পারাপারহীন সমুদ্র সেটি ঠিক এভাবে আছে কিনা সে নিয়ে আমি চিন্তিত নই। কিন্তু আমার কাছে সেই কুয়াশা ও হিমের সমুদ্র চরম বাস্তব। রবীন্দ্রনাথের গানের হাত ধরে সে-সমুদ্রের ধারে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকা যায়।
            আমাদের পরিবারে, যাকে বলে রাবীন্দ্রিক পরিবেশ একেবারেই ছিল না। মাঝে মাঝে ভাঙাচোরা এক রেডিওর পেট থেকে ভেসে আসত রবীন্দ্রনাথের গান। কালেভদ্রে মা গুনগুন করত দু-একটি। ব্যস, এর বেশী রবীন্দ্রনাথ ছিলেন না আমাদের জীবনে। কিন্তু সে জীবনেও রবীন্দ্রনাথের গানের হাত ধরে এক কুয়াশা ঢুকে পড়েছিল নিঃশব্দে।
            আসলে কুয়াশা বলে কিছুই হয় না। কুয়াশা একটি বোধ। মাথার মধ্যে একবার সে-কুয়াশা প্রবেশ করলে আমাদের জীবন আর আগের মতো থাকে না। আজকাল নিয়তীর মতো মনে হয় সেসব ঘটনার সমাপতন। রবীন্দ্রনাথের একটি শেষ-শরতের-গান আমার কাছে সেই নিয়তী ও কুয়াশার সমনাম।
            আমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে প্রথম শুনেছিলাম সেই গান ছোট বাড়ি পারিবারিক অনুষ্ঠানে আত্মীয়-স্বজন এসেছেন অনেকে। অসবার জন্য শোয়া-বসার স্বাচ্ছন্দ্য নেই। সারারাত কাটিয়ে দেবার সব থেকে ভালো পদ্ধতি ছিল একটা ঘরে গানবাজনার আসর বসিয়ে দেওয়া সব থেকে ছোটটি নজরুলের একটি ছড়া আবৃত্তি করে ঘুমিয়ে পড়েছে তারপরই হয়তো কেউসোহাগ চাঁদ বদনি…’ ধরবে অপটু গলায়
            সেবার হেমন্তের দিকে ঢলে-পড়া শরতের রাতে একটি মেয়ে গেয়েছিল, ‘হিমের তাতে ওই গগনের দীপগুলিরে
হিমেরওওওওও…’ শব্দটি ছড়িয়ে পড়ছিল অন্ধকারে ঘুরে বেড়াচ্ছিল একা একা। খালি গলায় গাওয়া গান গানটি শেষ হয়েছিল এক নিস্তব্ধতায় নিস্তব্ধ এক ঘরে এসে বসেছিল হেমন্ত-কুয়াশা

আনন্দ-বিষাদ পেরিয়ে এ-গান আমার কাছে ছায়াপথের শেষে পড়ে থাকা কুয়াশা-সমুদ্রের ধারে জেগে থাকা একটি গান চির রহস্যের গান বহুদূর থেকেআলোক আলোক আলোকবর্ষ দূর থেকে ডাক আসছে, ‘দীপালিকায় জ্বালাও আলোএরপর রবীন্দ্রনাথ যে বলবেনই, ‘জ্বালাও আলো, আপন আলো, সাজাও আলোর ধরিত্রীরে’, সেটিও বেশ প্রেডিক্টটেবল কিন্তু পঞ্চম লাইনে এসেই গানটির মধ্যে হুহু করে ঢুকে পড়ে রিক্ততার এক পৃথিবী
            শরতের ফুলের বাগান শূন্য কাশ ঝরে যাচ্ছে নদীর তীরে
            সুচিত্রা মিত্রর কন্ঠে গানটি শোনবার সময় আমি সত্যি সত্যি কাশের ঝরে যাওয়া দেখতে পেয়েছি গানটির মধ্যেই দেখতে পেয়েছিঝরে যায়’ ‘ঝরে যায়’… প্রতিবার এই কথাগুলি উচ্চারণের সময়ে অলৌকিক এক থেমে যাওয়া ওই সময়টুকুতেই কাশ ঝরে ঝরে পড়ছে কুয়াশার ভিতরনদীর তীরে
            এই গানটির মধ্যে এক তীব্র দোলাচল আছে অন্ধকার ও হেমন্ত থেকে আলো ও দীপের মধ্যে একটি চোরা পথ রবীন্দ্রনাথ পায়চারি করছেন সেখানে এক অনঙ্গ আঁধারকে জয় করতে বারবার আলো জ্বালাবার আকুতি
            এবং একদম শেষ দিকে এসে তিনি লিখছেন, ‘এল আঁধার দিন ফুরালো
            এই অনন্ত হাহাকার ও কুয়াশামাখা বাস্তবতাকে ছাড়িয়ে তিনি চলে যেতে চাইছেন আবার সেই আলোর জগতে মৃত্যুর পর ফুটে উঠছে একটা জীবন
            এ গান সন্ধ্যার গানও বটে দিন ফুরিয়ে আসছে দীপালিকার সন্ধ্যায় দীপটি জ্বেলে তুলে ধরতে হবে ছায়াপথের দিকে সে আলো মৃত্যুদীপের মতো স্নিগ্ধ ও সুন্দর সে আলো ব্যক্তিমানুষেরও। দীপালিকায় নিশ্চয় দীপ জ্বলে উঠেছে দিকে দিকে। কিন্তু ব্যক্তিমানুষের সেই একটি দীপ ছাড়া তামস দূর হবার নয়।
            এ গানে উল্লেখিত তামস যে একেবারেই পৃথিবীকে ছেয়ে থাকা অন্ধকার নয়, সেটা সকলেরই জানা। অনেকের কাছেই এটি একটি তীব্র আলোর গান।
            আমার কাছে এ গানের প্রতিটি শব্দ লুকিয়ে রয়েছে সেই মহাজাগতিক কুয়াশা। হেমন্তিকা তার সব রহস্য দেখতে দেবে না। আমাদের কল্পণা যতদূর বিস্তৃত হতে পারে তারও পরে পড়ে থাকবে এক কুয়াশার সমুদ্র। তার বালুতটে আছড়ে পড়া ঢেউ-এর আভাস মাঝে মাঝে স্বপ্নে ধরা দেবে আমাদের। কিন্তু তার সবটুকু কিছুতেই বোঝা হয়ে উঠবে না।
            রবীন্দ্রনাথ’ও কি জানতেন না, যে কোনও আলো দিয়ে… এমনকি আপন আলো দিয়েও সেই মহা-অন্ধকারের শেষ পর্যন্ত পৌঁছান যায় না! সে আঁধার তো আলোর অধীক।
            আমার তীব্র বিশ্বাস তিনি জানতেন। জানতেন, সেই কুয়াশা-সমুদ্রের শেষ নেই। তার পরপারে পৌঁছান যাবে না। এবং জানতেন বলেই বারবার আলো জ্বেলে দীপ তুলে ধরবার এই সুতীব্র তাড়না।
            ছায়াপথের শ্রেষ্ঠতম মানুষটিও সে কুয়াশার সামনে কিছুটা অসহায়…



No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না  যে পিতা সন্তানের লাশ সনাক্ত করতে ভয় পায় আমি তাকে ঘৃণা করি- যে ভাই এখনও নির্লজ্জ স্বাভাবিক হ...

পাঠক-প্রিয়