ইতিহাস , সংস্কৃতি ও সমাজচেতনা
ইতিহাস চেতনার দায় বড় বালাই । বর্তমানের ঘরে তা বড় ঘা দেয় । যার চোখে যা নীতি , তার বাইরের কিছু ঘটনা , চোখে পড়লেই প্রতিবাদহীন আন্দোলন বুকের ভেতরটা কুঁড়ে কুঁড়ে খায় । ঘটনার অনেক ঘনঘটা , তোমার স্মৃতিকে শঙ্খ বাজিয়ে অভিনন্দন জানাবে । সেই ঘটনাই আবার বর্তমানের সাথে উপযুক্তভাবে মানিয়ে নিতে না পারলে , তোমার মনকে কষ্ট দেবে , অবশ্যই তবে যদি তুমি মননশীল হও ।
পুরোনো যুগে , গ্রীসে গীতিময় নাটকের অভিনীত ঘটনাগুলো দর্শক উপভোগ করতেন , পাহাড়ের ধাপ কাটা জায়গাতে বসে বসে । গ্রীসের অ্যাম্ফি থিয়েটার সম্পর্কে সারা পৃথিবীর নাট্যপ্রেমী মানুষ অল্প-বিস্তর জানে । পরে অ্যাম্ফি থিয়েটারের মতো আরও অনেক থিয়েটার বিভিন্ন দেশে গজিয়ে ওঠে এবং জনপ্রিয়ও হয় । পরবর্তীতে জাপানের কাবুকি থিয়েটারও একইরকম জনপ্রিয়তা পেয়েছিল ।
থিয়েটারের দর্শকদের সে-সময় ঋকপুরুষের মতোই সম্মান দেওয়া হতো । কারণ তাঁরা ছিলেন সব উচ্চবর্ণের মানুষজন । তাঁরা নাটক দেখতে এসে অভিনেতাদের মতো অবহেলিত সম্প্রদায়কে সম্মান দিয়েছেন । নিজেদের মূল্যবান সময় নষ্ট করেছেন । অথচ এখন দেখুন , এই ব্যাপারটা পুরোপুরিই উল্টো । আর তখন তো অভিনেতাদের অনেকেই ছিলো দরিদ্র , নিম্নশ্রেণির মানুষ অথবা ক্রীতদাস । আর এখন অভিনেতারা কে কত ধনী ব্যাক্তি ? কার কটা বাড়ি গাড়ি , কতবেশি ব্যাঙ্ক ব্যালান্স , জীবনে মোট কতগুলো বিয়ে করে যৌতুকে ঠিক কী কী পেল ? ইত্যাদি ইত্যাদি ।
যাইহোক আগের কথায় ফিরে আসি । তা প্রায় ঐসময় থেকেই , নাটকের মধ্যে দৈনন্দিন ঘটনা সব জায়গা নিতে থাকে কখনো সহজ নিয়মে আবার কখনো বিকৃতরূপে । সে প্রবণতা আজও চলছে । শুধু পরিস্থিতি অনুযায়ী সেই দর্শক এখন আর ঋকপুরুষ নয় । তারা আমাদের মতোই সমাজবদ্ধ জীব । তাদের ভালোলাগা মন্দলাগা তারা জোর গলায় জানিয়ে দেয় । ফলে সুবিধা হয়েছে কী , নাটক সর্বস্তরে প্রভাব ফেলেছে বারেবারে । তা সে সমাজের প্রচলিত নিয়মের বাইরে গিয়ে কিছু তুলে ধরুক অথবা শাসকের স্বৈরাচারিতা চোখে আঙুল ঢুকিয়ে ( থুরি , দিয়ে ) দেখিয়ে দিক ।
অতীতের কোন কোন ঘটনা , আন্দোলন , কোন সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থা , ইতিহাসের ঘরে কতটা জায়গা করে নিয়েছে , বর্তমানে তা শুধু বারবার সিনেমা থিয়েটারে তুলে ধরা , লোকমুখে প্রচলনের দ্বারা , বেশ বোঝা যায় । পরবর্তী এইসবগুলোই বর্তমানের শেকড়ে জমে থাকে । সাংস্কৃতিক যত ইচ্ছা অতীতে প্রকাশিত হয়েছে কী হয়নি , তার উপর সংস্কৃতিকে বিচার করা যায়না । স্বাধীনোত্তর ভারতে সংস্কৃতি কীভাবে তার পূর্বধারা বজায় রেখেছে । তা জানতে গেলে আমাদের দূরের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে ।
মানুষ চোখ দিয়ে যা দেখে , নাক দিয়ে যে গন্ধ পায় , আঙুল দিয়ে যা পরশ করে এবং হৃদয় দিয়ে যা অনুভব করে , এই সব কিছু অতীতের নাগরিক চেতনার প্রকৃষ্ট উপাদান । আর ঐ উপাদানের প্রত্যক্ষ প্রভাবে ইতিহাসের একটি পশ্চাৎপট তৈরি হয়েছে বলে যদি ঐতিহাসিকেরা মনে করেন , তবে সেই একই নিয়মে বর্তমানে মানুষের ভাবনার বহিঃপ্রকাশ বদলে যেতে পারে । তবে তা পৃথিবীর কতটা ভালো করবে না খারাপ করবে , সে-কথা কেউ হলফ করে বলতে পারবে না । পরিবেশের সংস্কৃতিসম্পন্ন আবহাওয়ায় মনের অলিন্দ খোলা থাকলেই স্নিগ্ধ বাতাসে ভর করে ঢুকে পড়ে বিশুদ্ধ আত্মার কোনো অনির্বান আলো ।
স্বাধীনতা পূর্ব ভারতে ছোটো ছোটো জাতিগোষ্ঠীর ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ সংগ্রামের জন্য পা বাড়িয়েছে যতরকম অব্যবস্থা ও অসাম্য অত্যাচারের বিরুদ্ধে ( যেমন-- সাঁওতালদের উলগুলান ) । ঐসব অশিক্ষিত গোষ্ঠীকেও তাদের পূর্ব ইতিহাস ( পাঠ্যপুস্তকে রচিত না থাকলেও ) সুষ্ঠু সমাজ গঠনের চেতনা দিয়েছে । এ কথা বলাই বাহুল্য ।
ইতিহাসবীদেরা ইতিহাসের ঘরে বাস করেননি । পূর্বসূত্র সংগ্রহের মাধ্যমে নিশ্চয়তা পেয়েছেন যে-কোনো অতীত ঘটনা ও ব্যবস্থা সম্পর্কে । তাও আবার একই ঘটনা সম্পর্কে তাঁদের মধ্যে অনেক ভিন্নমতও রয়েছে । তবে তাঁরা সবাই এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে , তখনকার মানুষের রাজনৈতিক চেতনা সমাজ গঠনে একটা বিরাট ভূমিকা পালন করত । সমাজ তার তৈরি সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতো নিজস্ব পরিচয়কে অক্ষুন্ন রাখার জন্য । এখনও তাই-ই হয় কিন্তু ইতিহাসের কাছে সংস্কৃতির উত্তরাধিকার চেয়ে নিতে হয়েছে বর্তমানকে । পাহাড়ের গায়ে খোদাই , যেমন এখন পোশাকিভাষায় ভাস্কর্য্য হয়ে উঠেছে । কাঠকয়লা আর গেড়িমাটির বদলে এসেছে নানান ধরনের রঙ ।
চেতনার গভীরতা একই আছে , শুধু তার রূপ ও প্রকাশভঙ্গী পালটে গিয়েছে । বর্তমান সময়ে পরাধীনতার বিপ্লব বিশ্রাম নিয়েছে । তাই নিজেরই শরীরে আগুন জ্বালিয়ে এগিয়ে যাওয়ার মতো দুঃসাহসী খুঁজে পাওয়া যাবে না । স্বার্থ সন্ধানে তারা ভীষণই ব্যস্ত । পরাধীন ভারতেও ব্রিটিশ পদলেহন করা স্বার্থসন্ধানীরা ছিল , তবে এমন বেপরোয়া হয়ে ওঠেনি তখনকার সময়ের মানুষগুলো কখনও , লোকলজ্জার ভয়ে । তাই সংস্কৃতি ঐসময় তার লাবণ্য হারায়নি । আজ সংস্কৃতিও বড়ো হিসেবী পথে পা বাড়িয়েছে । সে তার গুণের কদর করতে গিয়ে নিজের ঢাক নিজেই পেটায় নির্বিচারে । সমাজ নিজেই নিজেকে ইতিহাসের আয়নায় দেখতে ভুলে গেছে এখানকার ডিজিটাল পৃথিবীতে ।
জীবন ও সংস্কৃতির একটা বড়ো অংশ সাহিত্য । সাহিত্যের প্রকাশভঙ্গীর আলাদা আলাদা মাধ্যম রয়েছে । সেখানে কবিতার মাধ্যমে সমাজচেতনা এক মহান চিন্তনজনিত ব্যাপার । বহু প্রাচীনকাল থেকে কবিতা সমাজ গঠনে এক সুগভীর ভূমিকা নিয়েছে । শুদ্রক ও কালিদাসের সময় থেকে কবিতার প্রতি মানুষের অমায়িক প্রেম আর দুর্বলতা কবিতাকে এই জায়গাটা পাইয়ে দিয়েছে । কাব্যকথায় মানুষ ছন্দের জবানিতে চেতনার দুয়ার খুলত । প্রায় তখন থেকেই কাব্যকে সুরের মাধ্যমে বেঁধে ফেলার একটা প্রয়াস দ্যাখা যায় । গান তৈরি হতে থাকে কবিতার কাঠামোতে সুর প্রলেপ দেওয়ার মাধ্যমে । কবিতাতে মানুষ নিজেদের আর সামাজিক সমস্যাগুলো খুঁজে পেতে থাকে । তারপর একে একে সৈয়দ আলাওল থেকে ভারতচন্দ্র এবং ভুসুকপাদ থেকে কাহ্নপাদ ধর্মে , চর্যাপদে কবিতার জায়গা শক্ত করে তোলেন । তাদের লেখা কবিতায় রূপকথা স্থান পেতে থাকে । সৌন্দর্য এক নতুন মহিমায় কবিতার মাধ্যমে নিজ রূপ মেলে ধরে । এরপর শিশুমনে রবীন্দ্রনাথ আর সুকুমার রায় তাদের মতো করে কবিতার শরীর প্রতিষ্ঠা করেন । কবিতাকে জীবনদর্শনের মূল উৎস করে তোলেন একের পর এক কাব্যরথী । সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে জীবনানন্দ দাশ , অথবা অতি আধুনিকে শক্তি চট্টোপাধ্যায় থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় । তালিকা এখনও শেষ হওয়ার নয় ।
কবিতার প্রায় সম-সাময়িক সময়ে আসতে থাকে নীতিকাহিনি । এই সকল উচিত অনুচিতের গল্পমালা আমরা ঈশপের কলমে পেতে থাকি । যদিও এর আগে কিছু প্রচলিত লেখা মিথ হয়ে গিয়েছিল লোকমুখে প্রচারের ফলে । কবিতার মতো শিশুমনে সঠিক নীতিগুলো গল্পের আকারে মজাদার করে জায়গা করে দেওয়া হতে লাগল । শিক্ষা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে জনগনের পরিণত মনের বিকাশ ঘটতে থাকে । পৃথিবীকে নতুন করে জানার উদ্যম তখন শুরু হয় বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত সম্মানীয় মানুষদের গুরু-গম্ভীর বিবৃতির মাধ্যমে । এ সময়টা অবশ্যই ভারতে সুলতানি সাম্রাজ্যে স্থাপনেরও অনেকটা আগে থেকে । প্রায় সেই সময় থেকে প্রবন্ধ নিজ জায়গা করে নিতে থাকে । যদিও নাটক এসেছিল মানুষের আদিম প্রবৃত্তির বিনোদন থেকে । প্রবন্ধে মানুষ রাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে সরাসরি মুখ খুলতে শুরু করে । যেভাবে নাটকের চরিত্ররা মঞ্চ থেকে সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে মুখ খোলে , ঠিক সেভাবেই । আজও এই বর্তমান সমাজব্যবস্থায় কবিতা গল্প ও প্রবন্ধ তাদের নিজস্ব প্রকাশভঙ্গিতে অম্লান । তবে রাষ্ট্রব্যবস্থার দাক্ষিণ্যে ও মোহ নামক মহিষাশুরের আক্রমনে অনেক সাহিত্যিকের কলম জ্বলন্ত সত্যকে অর্ধ-সত্য বলতেও দ্বিধা করে না আজকাল । আবার অনেক সময় সাহিত্যিকদের কলমেরও মেরুকরণ হয়ে যায় এ-যুগে । সে-সব ঘটনারও সাক্ষী আছি আমরা অবশ্যই ।
জীবন তো বহমান একটি নির্দিষ্ট সামাজিকতার মধ্যেই । এই রীতির বাইরে অনেক মানুষেরা গোপনে জীবনধারণের চেষ্টায় থাকেন । সেখানে অপ-সংস্কৃতি প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে, এমন ধারণা সমাজের নিয়ম-নীতিবান মানুষের মধ্যেই রয়ে গিয়েছে । কিন্তু কিছু যুক্তিবাদীর ধারণা অনুযায়ী, বর্তমান পরিকাঠামোয় পুরোনো ধ্যান-ধারণা থেকে বেরিয়ে আসার সময় হয়েছে । একটা সাদা কথায় উদাহরণ দেওয়া যাক । সমাজের শিষ্টাচার অনুযায়ী, পরকীয়া জঘন্যতম অপরাধ । কিন্তু সম্প্রতি সুপ্রীম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ ঘোষণা করল, পরকীয়া আইনসম্মত কাজ । একটা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের অধিকার আছে, যৌনসুখ থেকে নিজেকে বঞ্চিত না রাখা । কারণ জীবন একটাই । বিবাহিত জীবনে কেউ যদি যৌনসুখ আহরণে বঞ্চিত হয়, তাহলে সে তার ইচ্ছানুযায়ী পরকীয়ায় যেতেই পারে । সুতরাং এখানে সুপ্রীমকোর্টের নির্দেশানুযায়ী জীবন কাটালেই সমাজবিচ্যুতি ঘটবে । এ-কথা বলাই যায় । যদিও-বা আইনগত স্বীকৃতি দিয়ে মানুষের সুখের উপাখ্যান তৈরি করা যায় না । মানুষ তার মননের নিজস্ব ভালোলাগা অনুযায়ী সুখী হয় । এ-ক্ষেত্রে ডেল কর্ণেগীর এক বিখ্যাত উক্তি আছেঃ "মানুষের টাকা-পয়সা তার সুখ ডেকে আনে না । মানুষের মন প্রতি মুহূর্তে যা চিন্তা করে, তার উপরেই মানুষের সুখ শান্তি নির্ভর করে"।
তথাকথিত ভারতবর্ষে আর্য সম্প্রদায়ের আগমন ও বসবাসের পূর্ব থেকে কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত মানুষ ঋষিদের মুখনিঃসৃত বাণীকেই আপ্তবাক্য মেনে এসেছে । সে-সব উপদেশ, উপাচার এবং ছন্দময় কথাগুলো বাণী মন্ত্র ও গান হিসেবে চারটি পর্বে বেদ শাস্ত্রে অন্তর্ভুক্ত । কিন্তু ধীরে ধীরে মানুষ ভয় আর অনুশাসনের মধ্যে চলে আসছিল । নিয়মতন্ত্রের ঘেরাটোপে বেঁচে থাকাই হয়ে উঠেছিল তাদের একমাত্র রীতি । তখনকার সময় যে-সব সালংকারা যৌন সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল, তারা তাদের জীবদ্দশায় কদাচিৎ পূজা, উপাচার এবং যজ্ঞকুন্ডের সামনে আসার অনুমতি পেত । গৌতমবুদ্ধের সময় থেকে এই অবস্থার সামান্য বিচ্যুতি নজরে আসতে লাগল । বিভিন্ন পূজা-পার্বণ ও যজ্ঞে পশুবলিকে নিষ্ঠুরতার এক পর্যায় বলে উল্লেখ করলেন গৌতমবুদ্ধ । তিনি আরও বললেন যে, পরাধীন জটাজাল থেকে মুক্ত হয়ে শান্ত আর অহিংস হয়ে ওঠার কথা । ধ্যান আর যপ-তপের দ্বারা নিজ আত্মার শুদ্ধীকরণের কথা । গৌতমবুদ্ধ বলতেন, জীবন হলো কষ্টার্জিত এক অধ্যায় । তাই জীবনের পথে নতুন করে হিংসার আগমন যেন না ঘটে । বৌদ্ধদের জীবনদর্শণের মূলেও আমরা সেই অহিংসা সততা আর শান্তির বাণী পেয়ে থাকি । আবার সমসাময়িক জৈনধর্মের পৃষ্ঠপোষক মহাবীরের ধর্মপ্রজ্ঞা ও জৈনদের জীবনধারণও ছিল বৌদ্ধদের সমতুল্য । জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির একমাত্র রবীন্দ্রনাথ আস্তিকতায় বিশ্বাস রাখলেও বুদ্ধদেবের চিন্তা-ভাবনাকে অভ্রান্ত বলে মনে করতেন । তাঁর বিভিন্ন লেখনীতেও তিনি বুদ্ধদেবের সৌম্য, শান্ত স্থিরতা তুলে ধরেছেন । তাঁর রচিত বিসর্জন নাটকেও তিনি বলিপ্রথার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছেন । কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কাছে জীবন ছিল আনন্দের স্বরূপ । তাঁর কথায় প্রকৃতির এই মনোরম দৃশ্য আনন্দের উৎস । সমাজ আনন্দের দিশা দেখলে সে আর নতুন সুখের অন্বেষণে বিপথে যায় না । মৌর্যযুগে কলিঙ্গযুদ্ধের পর সম্রাট অশোকের একমাত্র উপলব্ধি ছিল যে, যুদ্ধ থেকে একমাত্র প্রাপ্তি হয় শুধুই মৃত্যু । রাজ্য বিস্তারের মোহে অমৃতের পুত্র মানুষের মৃত্যু কখনোই গ্রহণযোগ্য নয় । পরে অশোক নিজেই অহিংসার বাণীর মাধ্যমে বৌদ্ধধর্মের প্রসার ঘটানোর জন্য তাঁর পুত্র মহেন্দ্র ও কন্যা সংঘমিত্রার উপর ভারতবর্ষের দু-প্রান্তের দায়িত্ব তুলে দেন । এর পর সুলতানী ও মুঘল সাম্রাজ্য একে একে হিংসার পরাক্রমে আবদ্ধ হয়ে পড়ে । এ-ক্ষেত্রে দ্যাখা গিয়েছে যে, অন্য কোনো শাসকের যে রাজ্য যুদ্ধের মাধ্যমে এক শাসক ছিনিয়ে এনেছেন, কয়েক দশক পরে বিজিত শাসকের পুত্র সেই রাজ্যটাই পুনরায় উদ্ধার করেছেন যুদ্ধের মাধ্যমেই, বিজয়ী শাসকের পুত্রকে পরাজিত করে । তাহলে কয়েক দশকের ব্যবধানে এই দুটি যুদ্ধের মোট ফলাফল এক বিরাট শূন্য ছাড়া আর কিছুই নয় । আর এই যুদ্ধ দুটির মাঝে পড়ে কয়েক লক্ষ নাগরিকের ভয়ংকর মৃত্যু এবং সাম্রাজ্য দুটির অমূল্য ক্ষয়ক্ষতি । তবে স্বাধীনতা পূর্ববর্তী ব্রিটিশ শাসনে মহাত্মাগান্ধি অহিংস পদ্ধতিকে অবলম্বন করেই এ-দেশে আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছেন । যা নিয়ে বিস্তর তর্ক-বিতর্ক রয়ে গিয়েছে । নেতাজি কখনোই গান্ধিজির এই অনমনীয় মনোভাবকে মেনে নিতে পারেননি । অত্যাচারী শাসকের করাল গ্রাস থেকে পরাধীন দেশকে মুক্ত করার পন্থা শুধুমাত্র "অহিংসা" হতে পারে কি না, তা নিয়ে ভবিষ্যতে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে আরও বেশ কিছু চুলচেরা বিশ্লেষণ হতেই পারে । যদিও কংগ্রেসের দুই মহারথির এই মতভেদের জেরেই ভারতবর্ষের এই সর্ব বৃহত্তম রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সদস্যরা নিজ নিজ মতানুযায়ী, চরমপন্থা আর নরমপন্থার আদর্শে নিজেরাই ভিন্ন দুটি দল গঠন করেন । তবে এটা নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, প্রতিটি পন্থার গন্তব্য ছিল এক, কিন্তু গমনের পথটা আলাদা ।
ইতিহাসের প্রতিটি পর্বে অথবা যুগে সামাজিকতার একটা স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় । আমরা আগেও জেনেছি যে, হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতাও এক কঠিন সামাজিকতার মোড়কে শ্বাস ফেলত । সেখানকার কোনো কোনো বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে বহু-বিবাহের প্রচলন থাকলেও নারীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন একটি রীতির মধ্যেই পড়ত । সেই রীতি বর্তমান সমাজেও রয়ে গিয়েছে । এখান থেকেই সংস্কৃতির চর্চা ধীরে ধীরে মহা আড়ম্বরে পাখা মেলতে শুরু করে । অর্থাৎ সঠিকভাবে বলা যায়, সংস্কৃতি সমাজের নাড়ি ছুঁয়ে দেখতে চেষ্টা করে । এখানে মানুষ তার শিশুকাল থেকেই সামাজিক হয়ে ওঠে, নিজের পূর্বপুরুষের সঠিক দীক্ষা আর চেতনায় । বিপরীতে বুদ্ধিনাশ, অতীতের অনেক উদাহরণ থেকেই পাওয়া যায় । তা সে মহাকাব্যের ঘটনা অথবা ইতিহাসের ঘটনা, যা-ই হোক না কেন । এখানে ক্ষমতার মোহের কারণে লোভ একটা বড়ো ভূমিকা পালন করে এসেছে যুগ-যুগ ধরে । সমাজ চরম দুর্দশায় ভুগতে থাকে এমন কিছু সর্বগ্রাসী মানুষের জন্য । নিজেদের সুযোগ সুবিধা ও আমোদকে সর্বোচ্চ শিখরে তুলতে গিয়ে এরা সামাজিক নিষিদ্ধ কর্তব্যেও নিজেরা যুক্ত হয়ে পড়ে । আর ঠিক সেই অবস্থাতেই সমাজ ও সংস্কৃতির দড়ি দুটোর গিঁট খুলতে শুরু করে । সুতরাং বলাই যায় সংস্কৃতি এবং সমাজ, একে অপরের পরিপূরক । আর ইতিহাসের কাল থেকে শিক্ষা নিয়েই এই সম্পর্কটিকে পরিপূরক এবং একটু একটু করে মানবদরদী করে তুলতে হয় । এটা সময়-সাপেক্ষ একটা ব্যাপার । কোনো দেশ অথবা জাতি কোনোদিনও খুব কম সময়ের মধ্যে এমন সুনিপুণ অবস্থায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি । পরিস্থিতি যা-ই আসুক না কেন, ইতিহাসের গভীরে অবগাহন না করতে পারলে সমাজের স্বরূপ প্রতিভাত হয় না । পুরোনো যুগের মহাপুরুষদের মুখেও আমরা এ-জাতীয় কথা বিভিন্ন আঙ্গিকে শুনেছি । আর ইতিহাসের সঙ্গে সমাজ ও সংস্কৃতির একটি সুন্দর ভারসাম্য থাকলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেহটা অক্ষত থেকে যায় । আমরা শ্রীরামকৃষ্ণের সেই বিখ্যাত বাণী "যত মত তত পথ, কালী খ্রীষ্ট আল্লাহ সবই এক" অবশ্যই শুনেছি । তা ছাড়া বিভিন্ন ধর্মের একাধিক মনীষী সমাজকে সুষ্ঠু ও চলনশীল রাখতে নানা উদাহরণ দিয়ে গিয়েছেন । কারণ তারাও দেখেছেন, অনৈতিকতা ইতিহাসের ঘরেও অনেক সভ্যতাকে কালের অতলে তলিয়ে দিয়েছে । "বন্যরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে" এই বহুল প্রচলিত প্রবাদ বাক্যটি স্ব-স্ব সমাজের জন্যই প্রযোজ্য । এখানেও ইতিহাস বুঝিয়ে দিয়েছে যে, প্রত্যেক জাতিকে তার নিজ নিজ সমাজে আপন সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসেবেই উদাহরণ হয়ে থাকতে হবে ।
অনেক ভাবনা মনের গহীন থেকে মাটি ও তুলি রঙে পুতুল হয়ে ওঠে । কিছু তার কল্পনা, কিছু তার বাস্তব । সকল সৃষ্টি প্রকৃতির অথবা প্রকৃতি থেকেই উদবৃত্ত, এ-কথা আমাদের স্বীকার করতেই হয় । বেদের যে চার খন্ডে সমাজের রূপ-মোহ, সৌন্দর্য ও কর্তব্য-কর্মের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে, তা আজও প্রাসঙ্গিক । ভালো করে অক্ষর জ্ঞান হওয়া মানুষগুলো অতীত জানতে চেয়েছেন নিজেদের বংশ পরিচয়ের হদিশ খুঁজে পাওয়ার জন্য । আর তা চাইতে গিয়ে তারা অবলীলায় পৌঁছে গিয়েছেন কালের অতল অতীতে । মনু সহিংতা, বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট এবং নিউ টেস্টামেন্টের অনেক ধ্যান ধারণার সাথে আপাত সম্পৃক্ত । হিন্দু সনাতন রীতি ও ধর্ম অনুযায়ী পৃথিবীর আদি মানুষ মনু । হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী তিনি গর্হিত কোনো কাজ করেননি । সুতরাং তার দেখানো পথেই এই হিন্দু জাতীর সংস্কার ও প্রসার । প্রত্যন্ত গ্রাম্য অঞ্চলে ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের আচার অনুষ্ঠান এইরকম শাস্ত্রীয় কোনো ঘটনা উপস্থাপনের মাধ্যমে ঘটে থাকে । এই প্রথা বহুযুগ ধরে চলে আসছে, যেমন- রামলীলা । তবে ভারতীয় গনণাট্য সংঘ পশ্চিমবঙ্গে পথনাটকের প্রসার ঘটাতে এক বড়ো ভূমিকা নিয়েছে । পথনাটকের মাধ্যমে রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধিতে তখন অনেক নাট্যদল এগিয়ে এসেছিল । পুরোভাগে ছিলেন অনেক নাট্যকর্মী যেমন - পানু পাল, উৎপল দত্ত, বাদল সরকার, জোছন দস্তিদার, প্রবীর গুহ, উষা গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ । এই রামলীলা এবং পথনাটক রাস্তাঘাটে অভিনয় হয় বলে, চটজলদি মানুষের মনে ধর্মীর রীতিনীতি অথবা রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রবেশ ঘটানো সম্ভব হয় । ভারতীয় শিল্প-ঘরানা অভিনয়ের ক্ষেত্রে পথনাটক থেকে মঞ্চ নাটকেও সমান জনপ্রিয়তার ধারা বজায় রেখেছে । মঞ্চ তৈরিতে অতীত থেকে বর্তমানে থিয়েটার জগতে এক অনন্য নাম খালেদ চৌধুরী । মঞ্চ নির্মাণের অনেক পুরোনো ধ্যান-ধারনার মূলে কুঠারাগাত করে তিনি তুলে এনেছেন এক আধুনিক রীতি ।
ভারতের ইতিহাসে নজর রাখলে আমরা জানতে পারি যে, গুপ্ত সাম্রাজ্যের পৃষ্ঠপোষকেরা এমন সব শিল্প-সংস্কৃতির কদর করতেন, যা ভারতীয় দর্শন থেকে উঠে এসেছে । অবশ্য তার আগেই মৌর্য সাম্রাজ্য চিত্রশিল্পে ও ধনুর্বিদ্যায় শিল্পের প্রদর্শন করেছে বিশ্বের দরবারে । চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য একাধারে ছিলেন যোদ্ধা ও শিল্পের পৃষ্টপোষক । যদিও অতীত থেকেই ইতিহাস বারবার সাক্ষী দিয়ে এসেছে যে, শিল্পের সাথে ধর্মকে ওতপ্রোত জড়িয়ে দিয়েছে সেই সময়কার সমাজব্যবস্থা । যদিও সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থার স্বার্থে শিল্প থেকে ধর্মের চ্যুতি ঘটাতে রাজি ছিলেন না অনেক সম্রাট । সময় এগিয়ে চলে তার নিজস্ব ছন্দে । সুলতানি শাসনে আমরা এমন কিছু সম্রাটকে পেয়েছি, যাঁরা শিল্প সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন । তাদের মধ্যে বিশেষ করে মহম্মদ বিন তুঘলকের কথা বলতেই হয় । তিনি প্রভূত শিক্ষিত ছিলেন বেশ কয়েকটি বিষয়ে । তাঁর শিল্পের প্রতি দুর্বলতা সর্বজন বিদিত । তিনি নিজেও কিছু বাদ্যযন্ত্র বাজানো অভ্যাস করতেন নিয়মিত । তা ছাড়া প্রকৃত শিল্পানুরাগীদের তাঁর রাজসভায় যথেষ্ট সমাদর হতো । শুধুমাত্র কিছু বোধহীন সিদ্ধান্ত, যেমন "চটজলদি ঘোষণার মাধ্যমে রাজধানী স্থানান্তর", "তামার মুদ্রার বদলে রূপোর মূদ্রার প্রচলন", তাঁকে উম্মাদ সম্রাটের তকমা এনে দেয়, যা খুবই দুর্ভাগ্যের । ফলে তাঁর শিল্প সংস্কৃতির চর্চা মানুষের মন থেকে হারিয়ে যায় অচিরেই । কখনো যোগ্য উত্তসূরীর অভাবে, কখনো যুদ্ধের ভয়াবহ আবহে ধীরে ধীরে রাস্ট্রের শাসক পরিবর্তিত হতে থাকে । আর তার সাথে হারিয়ে যেতে থাকে এক এক যুগের অভ্যাস, জীবনধারণ পদ্ধতি, আর সংস্কৃতির রূপরেখা । মুঘল সম্রাট জাহিরুদ্দিন মুহম্মদ বাবর বারতের মাটিতে পা রাখেন, সাম্রাজ্য স্থাপনের আশায় । তিনি তাঁর লক্ষে অবিচল থেকে একাধিক যুদ্ধে সম্রাটরূপে পরিগনিত হন এই বিরাট ভারতবর্ষের । তাঁরও কিন্তু শিল্পের প্রতি অনুরাগ ছিল আগাগোড়া, এ-কথা বলাই যায় । কারণ তাঁর রাজসভা অলংকৃত করতেন শিল্পে আধিপত্য অর্জন করা বহু জ্ঞানী গুণীজন । এই একই ধারা সম্পূর্ণরূপে বজায় রেখেছিলেন তাঁরই পৌত্র উত্তসূরি মহামতি আকবর । তাঁর রাজসভায় শিল্পের কদর করা এমন অনেক সভাসদ উপস্থিত ছিলেন, যাঁরা ভারতবর্ষ তথা সারা বিশ্বে বিভিন্ন উৎকৃষ্ট শিল্পসৃষ্টি যেমন- সাহিত্য, সংগীত, নাট্যকলা, অঙ্কন প্রভৃতির বিরাট নজির রেখেছেন । শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা জাহাঙ্গীরের রাজত্বেও অল্প-বিস্তর দ্যাখা যায় । তবে শাহজাহান ছিলেন সৌন্দর্যের একনিষ্ঠ পূজারী । তাঁর রাজত্বে সৌন্দর্য কীভাবে শিল্পের সহস্র নিদর্শন হয়ে উঠতে পারে, তা আজ সারা পৃথিবীর কাছে এক দৃষ্টান্ত হয়ে আছে । কারণ ময়ূর সিংহাসন এবং তাজমহল নির্মাণে যে-পরিমান নিষ্ঠা আর অধ্যবসায়ের কাহিনি পাওয়া গিয়েছে, তাতে সংস্কৃতিবান মানুষ পুরোপুরি স্তম্ভিত । মুগল যুগ পরবর্তী সময়ে বাংলা শিল্প স্থাপত্যের এক উদাহরণ হয়ে উঠেছিল ।
সাংখ্য-যোগ, ন্যায়-বৈশেষিক, মীমাংসা-বেদান্তের ভিত্তিভূমি ভারতবর্ষে উপনিষদ তথা বিশ্ব আধ্যাত্মিকতা মুক্তির পথপ্রদর্শক গুটি কয়েক ভারতীয় শিল্পের সর্ব স্তরে নিজ অবচেতনেই নিজ কর্মের ছাপ রেখে গিয়েছেন, তা সত্যিই বিস্ময়ের ।
ঋষি বিশ্বামিত্র তপস্যার মাধ্যমে শাস্ত্রের বিবিধ বিধান দিয়েছিলেন । অথচ তিনি প্রাণপন তপস্যাতেও ব্রাহ্মধর্মে উত্তীর্ণ হতে পারেননি শুধুমাত্র ক্রোধের কারণে । এ-কথা লোকমুখে প্রচারিত । এ-দিকে তার কয়েক যুগ পরে, শাস্ত্রজ্ঞান রহিত আনমনা আপনভোলা মানুষদের মধ্যে যুগত্তীর্ণ হয়ে উঠেছিলেন গদাধর নামের একজন, পরবর্তীতে যিনি পরিচিতি পেয়েছিলেন শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব নামে । তবে অন্যান্য শাস্ত্রজ্ঞের মতো তিনি কখনোই গোঁড়া ও একরোখা জেদী প্রবৃত্তির মানুষ ছিলেন না । তাই তিনি সর্বধর্ম সমন্বয়ের উদ্দেশ্যে শাস্ত্রের উপরে উঠেও বলতে পরেছেন, "যত মত তত পথ, কালী খ্রীষ্ট আল্লাহ সবই এক" । এও এক সংস্কৃতি, অহিংসার সম্প্রীতির । সামান্য স্বল্প শিক্ষিত আপনভোলা ঐ মানুষটা সংস্কৃতির এমন একটা দিকের উল্লেখ করেছিলেন, যা সে-সময় পুস্তকে লিপিবদ্ধ ছিল না, এবং সমাজের তিন ধর্মের মানুষদের মধ্যে যা ছিল অপাংক্তেয় ।
ভারতীয় শিল্প সারা বিশ্ব জুড়ে এক অদ্ভূত উম্মাদনা সৃষ্টি করেছিল । যদিও সে-সময় শিল্প সংস্কৃতির চর্চায় বাংলা ছিল অন্যান্য প্রদেশের চেয়ে শতগুণ এগিয়ে । সমাজের গঠনের উপাদান সুন্দর হয়ে ওঠার পিছনে শিল্পের এক অসামান্য গুরুত্ব রয়ে গিয়েছে । অতীশ দীপঙ্কর নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ থাকাকালীন শিল্পচর্চার বিভিন্ন বিভাগ চালু করেচিলেন । তদুপরি তাঁর আগ্রহেই পাশ্চাত্যের বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে অনেক শিল্পানুরাগী নালন্দাতে স্থান পেয়েছিলেন শুধুমাত্র ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে নান্দনিক শিক্ষার বিকাশ ঘটানোর জন্য ।
ইতিহাস কালের গহ্বর থেকে বারবার উঠে আসে শিক্ষার চেতনায় । আমরা অস্বীকার করতে চাইলেও তা পারি না । যতই ভবিষ্যতকে নিয়ে ভাবিত হই, ততই ভীতি সারাটা মন জুড়ে বসে থাকে । কোনো একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা বোঝা যেতে পারে । যেমন- এলিয়েনদের কথা মাঝে মাঝেই শোনা যায় । যদিও এর সত্যতা সম্পর্কে অনেকেই সন্দিহান । তবে এই পৃথিবীর জন বিস্ফোরণে একদিন না একদিন পৃথিবীর ভারসাম্য নষ্ট হবে এটা ঠিক । তাই সময় হয়েছে অন্যগ্রহে বসবাসের । এটা একটা বুদ্ধিমানদের মনস্তত্ত্ব থেকে উঠে আসা যুক্তি । এই যুক্তিকে একইরকম ভাবে ক্রমশ প্রসারিত করতে থাকলে বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের মতো আরও বলা যায় যে, ডিমের ঝুড়ি সদৃশ এই পৃথিবী যে-কোনো মুহূর্তেই ভেঙে গেলে, আমরা কেউই বাঁচব না । তাই অন্য গ্রহে প্রাণ আছে কী নেই, নিরন্তর সেই গবেষণা আজ শুরু হয়ে গিয়েছে । সাইকোলোজির আরও গভীরেও লুকিয়ে থাকে সংস্কৃতির আদ্যোপান্ত ভাবনাগুলো । যেমন- দেওয়ালে অনেকগুলো বিন্দু পরপর সাজিয়ে দেওয়ার পর দূর থেকে দেখলে সেটিকে একটি লম্বা রেখা মনে হয় । সেভাবেই সংস্কৃতি একদিনে কোনো সমাজ বা জাতির মধ্যে সম্পৃক্ত হতে পারে না । বহু মানুষের ছিন্ন ছিন্ন সু-চিন্তিত কর্ম দিনের পর দিন মালার মতো সজ্জিত হতে হতে সংস্কৃতির জন্ম দেয় । এটি একটি বেশ পুরাতন পদ্ধতি । পাশ্চাত্যের বহু রাষ্ট্রই এই পদ্ধতিতে সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে । এখানে পূর্বশ্রুতি অনেক পরিচয়ও সংস্কৃতির উপাদান হিসেবে পরিচিত হয় । যেখানে যুক্তির প্রভাব, নথিপত্র ইত্যাদি থাকতেও পারে, কিংবা নাও পারে । উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, লালরঙকে কেন "লাল" না বলে "সবুজ" অথবা "হলুদ" অথবা "নীল" বলা যাবে না ? এর কী কোনো যুক্তি আছে ? সত্যিই তো এখানে কোনো যুক্তিই কাজ করে না । তবে উত্তরটা ঠিক এরকম হতে পারে যে, যেহেতু বর্ণ সৃষ্টির শুরু থেকেই পৃথিবীর মানুষ নির্ধারণ করে নিয়েছে, ঐ রঙটা লাল হিসেবেই পরিগণিত হবে, তাই ওটা লালরঙ । আবার শিশুও তার গুরুজনদের থেকে ছোটোবেলাতেই জানতে পেরেছে যে, ঐ রঙটা লাল । তাই সেও ওটাকে লালরঙ বলেই বিশ্বাস করে । সুতরাং বলাই যায়, এই নথিপত্র বিহীন বিশ্বাসও সংস্কৃতির এক উপাদান । তবে অবশ্যই এই উপাদানগুলো ধীরে ধীরে সংস্কৃতির গঠনে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে এসেছে ।
চেতনা যেভাবে মানুষের ব্যক্তিত্ব বাড়িয়ে তোলে ধীরে ধীরে, সেভাবেই ব্রহ্মচর্য রক্তে প্রতিস্থাপিত হয় নিষ্ঠা ও সংযমের দ্বারা সাধনার মাধ্যমে । তেমনই একটা প্রজন্মকে ধীরে ধীরে সংস্কৃতিকে আপন রক্তে প্রবাহিত করাতে গেলে সাধনাতে নিমজ্জিত থাকতে হয় । আর সমাজ সুষ্ঠুভাবে চালিত হয় প্রতিটি প্রজন্মের আগত অতিথিদের সুনিয়ন্ত্রিত দায়িত্বের মাধ্যমে । প্রাগৈতিহাসিক সুবিন্যস্তরূপে ইতিহাসে উত্তীর্ণ হয়েছে । ইতিহাস তার প্রচীনযুগের মোড়ক ভেঙে মধ্যযুগের ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে আধুনিকে এসে পৌঁছেছে ।
______________________________ __________
অসাধারণ একটি প্রবন্ধ।
ReplyDeleteঅনন্য একটি লেখা পড়লাম
ReplyDelete