Thursday, December 12, 2019

গদ্য- যশোধরা রায়চৌধুরী





কুয়াশাদিনকাল



চাপ চাপ ঘন কুয়াশা লেগে রয়েছে ওর গায়ে। ও আমার ময়দান। ও নাকি কলকাতার ফুসফুস। আমার কলকাতা। কালি ঝুলি মাখা, ধূমাবতী কলকাতা। দূষণে নীল হয়ে যাওয়া শহর। তার একটা ধমনী আছে গঙ্গা মা, আর একজোড়া ফুসফুস আছে সবুজ এই ময়দান।

 শরতের ভোরে সদ্য সূর্য উঠছিল যখন, ওকে দেখি। বহুযুগ আগে পড়া কোন লেখায় কখনো সকালবেলার ময়দান, সাদা কুয়াশার চাদর মুড়ি দেওয়া ময়দান, উঠে এল চিত্তপটে... মনটা আশ্চর্য সব ছবি আমদানি করতে লাগল। ঘাসমাটি থেকে এক ফুট উঁচুতে ভেসে আছে কুয়াশা কুয়াশা কুয়াশারা।  থোকা থোকা, কম্বলের মত সাদা।


 কমলালেবুর মত সূর্য টপ করে উঠে পড়ল লাইট পোস্টের খোঁদলে। ঘোড়াগুলো ঘাস খাচ্ছে। সিন্ডারেলার গাড়ির মত রং চঙে লোহার জালি ওয়ার্ক করা ঘোড়ার গাড়ি, লাল টুকটুকে তার গদি। সে গদিতে হাত পা ছড়িয়ে লুঙ্গি মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে টাঙাওয়ালা। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের আশপাশে। আগের রাত গেছে ষষ্ঠীর। কলকাতায় জোয়ার এসেছে। গাদা গাদা "বাইরের লোক" পুজো দেখতে কলকাতায় এসে পড়েছে, তাদের কেউ কেউ ঘোড়াগাড়িতে চেপে ফুর্তি করেছে নিশ্চয়ই। ব্যবসা হয়েছে বেশ ইসমাইল শেখ, টাঙাওয়ালার, হিঁদুদের এই পুজোর অবকাশে।

সকাল বেলার কুয়াশা , যেন তুলো তুলো। রাস্তায় কুয়াশা ছিল কি? হয়ত ঘন ঘন ট্যাক্সি গাড়ি বাস যেতে যেই শুরু করেছে কুয়াশারা থোকা থোকা পালিয়েছে উষ্ণ হয়ে ওঠা পিচরাস্তা ছেড়ে। আশ্রয় নিয়েছে তখনো শীতল, শিশিরাবৃত ঘাসের ওপর। ঘন হয়ে শুয়েছে যেন পরস্পরকে জড়াজড়ি করে। এভাবেই বাধাহীন থেকে যাবে যতক্ষণ না বল পেটাতে আসে বালকেরা। কোচিং শুরু হয় ক্রিকেটের। সবুজ ঘাসের ওপর শিশির দলে দলে, কুয়াশা ছিঁড়ে ছিঁড়ে যতক্ষণ না এক দল দামাল খেলুড়ে দৌড়তে থাকে মাঠ জুড়ে।

বাস স্টপে দেখি মেয়েটিকে। একলা, উশকো খুশকো চুল। সারারাত ঠাকুর দেখেছে । গোলাপি রঙের জামা ধক করে চোখে এসে লাগল। ছোট জামা। বিদেশি মডেলদের ছবিতে দেখেছি এমন। মেয়েটির সঙ্গে কেউ নেই কেন। ধর্মতলায় বাসের জন্য দাঁড়িয়ে। একলা মেয়েটি আমার মনে গেঁথে গেল। এও এক কুয়াশা। সঙ্গে বন্ধুরা ছিল। হয়ত হঠাৎ পাওয়া বয়ফ্রেন্ড ছিল। ছেড়ে গেছে? মেয়েটি ছেড়ে এসেছে? কোন কিছু ত স্পষ্ট নয় এখন। কোনকিছু জানা যায়না পুরোটা। মেয়েটি আর ছেলেটির ভেতরে ঠিক কী কী হয়েছিল। মেয়েটি কখন হাত ছেড়ে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যায়।

টিভিতে দেখি। একুশ বছরের ছেলে মরে গেছে। বাইশ বছরের বান্ধবীটি ফেসবুকে জোড়ে ছবি পোস্ট করেছিল। বান্ধবীকে নাকি ও পঞ্চাশ হাজার টাকার গিফট দিয়েছিল। কীভাবে পেল সে টাকাটা? বান্ধবীটি নাকি অন্য কোন বয়ফ্রেন্ড পেয়ে গেছিল। তারপর সেই বয়ফ্রেন্ড আর এই বান্ধবী মিলে ছেলেটাকে মেরে দিয়েছে। মাটিতে পুঁতে দিয়েছে মাথা। টুকরো টুকরো করে কেটেছে ধড়, সুটকেসে পুরেছে। ফেলে দিয়েছে গঙ্গায়।

এও ত কুয়াশা। সম্পর্কের কুয়াশা। ম্যারিটাল রেপ সহ্য করে করে বেঁচে থাকা মেয়ে শেষে পণের জন্য মরে যায়। সেও ত আত্মহত্যা , হয়ত সে মানসিকভাবে বিপন্ন হয়েই আত্মহত্যা করেছিল। তাতেই কি সব চুকে যায়? তার পেছনেও ত থাকে এইডিং অ্যান্ড অ্যাবেটিং। বুড়ো বাবা মাকে টাকা দেয়না ছেলে। বাবা মা রাস্তায় এসে দাঁড়ান। কুয়াশা। লোনের টাকায় জমি চষে সব ফসল ঘরে তুলেও দাম পায় না চাষি, সম্পন্ন চাষিকে আত্মহত্যা করতে হয় লোনের টাকা শুধতে পারবে না বলে। কুয়াশা। কতরকমের কুয়াশা আছে , উঠে আসছে প্রতিদিন আমার শহর আমার রাজ্য আমার দেশ থেকে। মাটি থেকে এক ফুট উঁচুতে ভেসে আছে কুয়াশা। থোকা থোকা, কম্বলের মত সাদা।
কুয়াশা ভাল, না খারাপ? কখনো কখনো মনে হয় কুয়াশার অনুষঙ্গ আসলে আমাদের দৈনন্দিন প্রবল বেদনাময় জীবনে এক প্রলেপ। যাকিছু কঠোর শুষ্ক কঠিন ব্যথা দেওয়া, তাকে ভুলিয়ে রাখার কৌশল নয়ত? আমাদের চোখে এসে কুয়াশা ঠেকলে কিছুক্ষণের জন্য তীক্ষ্ণ শলাকার মত অন্ধকার এসে ফুটে যাবে না । মনে পড়ে ভৌতিক আধিভৌতিক সব গল্প কাহিনি। মঁপাসঁ-র সেই বিখ্যাত গল্প, sur l'eau ( জলের ওপরে) যেভাবে কুয়াশাকে উদযাপন করে তা ভয়ংকর সুন্দরের উদযাপন।

নদী ধীরে ধীরে একটা সাদা ঘন কুয়াশায় ঢেকে গেছে, যেটা জলের ওপোর দিয়ে হামাগুড়ি দিতে দিতে, এমন দ্রুত এসেছে, যে নিজে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় আমি নদীকে আর দেখতে পাচ্ছি না, আমার পা দুটোকেও না, নৌকোটাকেও না, কিন্তু শুধু চোখে পড়ছে শরবনের ডগাগুলো, তারপর, অনেক দূরে, পূর্ণ চাঁদের  অতি বিবর্ণ আলো, সংগে, ইটালির পপলারের দঙ্গলগুলোর তৈরি করা বড় বড় কালো ছোপগুলো যারা আকাশের দিকে উঠছে।

আমাকে যেন ঢেকে ফেলেছে একটা অদ্ভুত সাদা রঙের তুলোর খন্ডের কেন্দ্রে, আর আমার কাছে তখন অবাস্তব কল্পনারা আসতে শুরু করেছে। আমি তখন দেখতে পাচ্ছি কেউ যেন আমার নৌকোয় উঠে আসার চেষ্টা করছে, যাকে আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি না। আর  এই অস্বচ্ছ কুয়াশায় আবৃত নদীটা, নিশ্চয়ই ভরে গেছে আশ্চর্য সব প্রাণীতে, যারা আমার চারদিকে সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে। আমি তখন অনুভব করছি এক বীভৎস অস্বস্তি, আমার মাথা ধরে গেছে, হৃৎপিন্ডটা এত জোরে ধকধক করছে যে আমার যেন শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে,  আর বোধ লুপ্ত হয়ে আমি ভাবছি,  সাঁতরে পাড়ে উঠে নিজেকে বাঁচাব; কিন্তু একটু পরেই এই চিন্তাটায় আমি ভয়ে কেঁপে উঠছি। নিজেকে তখন মনশ্চক্ষে দেখছি, যেন আমি হারিয়ে গেছি, এই ঘন কুয়াশায় অজানায় ঝাঁপ দিয়ে যেন আমি ঘাসপাতা লতা শরবনের ভেতরে হাত পা ছুঁড়ছি, ওগুলোকে সরাতে না পেরে, ভয়ে আর্তনাদ করতে করতে,  নদীর কিনারা দেখতে না পেয়ে, নিজের নৌকোটাকে আর খুঁজে না পেয়ে। আর আমার মনে হতে লাগল, যে আমি অনুভব করছি এই কালো জলের তলদেশের দিকে আমার পা ধরে কেউ টেনে নিচ্ছে।
এই ভয়াবহ বিবরণের পর হাত পা শিথিল, পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে গিয়েছে কথকের ভয়ে... কিন্তু তার কিছু পরেই সে কুয়াশা অবতীর্ণ হয়েছে নদীর প্রবল সৌন্দর্যের অলংকারে।


এতটুকু নড়াচড়া করতেও ভয় করছে। শেষ পর্যন্ত, নিজেকে তুললাম অসম্ভব সাবধানতার সঙ্গে, যেন আমার সমস্ত জীবন নির্ভর করছে সামান্যতম শব্দ যদি করে ফেলি আমি তার ওপর, আর বাইরের নৌকোর বাইরেটা আবার দেখলাম।

আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেল এক অপূর্ব, অদৃষ্টপূর্ব, বিস্ময়কর দৃশ্য দেখে। এসব তো পরীর রাজ্যের কল্পনালোকের দৃশ্য, এমন কল্পকাহিনির দৃশ্য, যা দূর দেশ থেকে ভ্রমণ করে এসে লোকে বলে, আমরা অবিশ্বাস নিয়ে শুনি।
যে কুয়াশাটা দু ঘন্টা আগে জলের ওপরে ভাসছিল, সেটা ধীরে ধীরে সরে গিয়ে দুই পাড়ে জড়ো হয়েছে। জলকে একেবারে মুক্ত করে দিয়ে, সেটা দুই পাড়ে রচনা করেছে এক একটা অবিচ্ছিন্ন পাহাড়, ছয় কি সাত মিটার উঁচু, যা চাঁদের আলোর নিচে জ্বলজ্বল করছে বরফের মত ঔজ্জ্বল্যে।  এমনভাবে সেটা করছে, যে কেউ আর কিছু দেখতেই পাবে না শুধু এই নদীর আগুনের ফলা আর দুপাশের দুই শ্বেত পর্বত ছাড়া, আর ওই উঁচুতে, আমার মাথার ওপর, জ্বলজ্বল করছিল , পূর্ণ, বিশাল একটি অতিকায় চাঁদ, নীলাভ দুগ্ধবৎ এক আকাশকে আলোকিত করা।
এই সব মিলিয়েই কুয়াশার বিপুলতা প্রায় লার্জার দ্যান লাইফ, অন্তত মোঁপাসঁর কলমে... ক্লাসিকাল বা রোমান্টিকদের কলমে তাই কুয়াশাই শেষ পর্যন্ত ভীতিপ্রদ জীবনের বিপরীতে আমাদের আপ্লুত করে। অসংখ্য ছায়াছবিতে সকালের কুয়াশাবৃত চরাচর নীলিমা এক শান্ত আর পিছুটানে ভরা আমেজের সৃষ্টি করেছে তাই।

কিন্তু যৌক্তিক পৃথিবীতে ত আমরা পছন্দ করিনা কুয়াশাকে। স্বয়ং রবি ঠাকুর নাহলে "এই কুয়াশা সর্বনেশে" বলতেন কি? আলোরে যে লোপ করে খায়, সে কুয়াশার বদলে তিনি আঁধারকেও স্বীকার যাচ্ছেন কেন তবে। "রাখিয়াছিলে অসাড় ক'রে;. বাহির হতে বাঁধিলে ওরে. কুয়াশা-ঘন জালে--. " বারে বারেই কুয়াশাকে তিনি দেখছেন সত্যের মুখ অপাবৃত  করে রাখার বাঁধন হিসেবে। "তোমার দলের লোকের ভালো-লাগাটা কুয়াশার মতো, যা আকাশের উপর ভিজে হাত লাগিয়ে তার আলোটাকে ময়লা করে ফেলে।" শেষের কবিতায় বলা হচ্ছে।  চিত্রাঙ্গদার স্বরূপ প্রকাশের সময়ে বলা হচ্ছে, "কেটে যাক রঙিন কুয়াশা,. দেখা দিক শুভ্র আলোক"...বারে বারেই অজ্ঞান- বিভ্রম- সংশয়ের সঙ্গে কুয়াশাকে মিলিয়ে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তারই মত করে আমরা ভাবতে শিখেছি , অনেকটাই।

আজো, কুয়াশার ভেতর দিয়ে পথ না দেখতে পাওয়ার অস্বস্তিকেই বুঝি মন্দ। জীবনের সার সত্য তবু এই হাতড়ে হাতড়ে চলা, কুয়াশাতেই। আর তা নিয়ে লিখে চলা একের পর এক কবিতা... বা খন্ড দিনলিপি।
এখন দিনগুলো যায় আহা যেন  অসাড় গণিত
সিঁড়িভাঙা অঙ্ক যায় আহা যেন ধাপে ধাপে শীত
নেমে আসছে পুকুরের শ্যাওলাপড়া কবিতা বাথানে
ধাপে ধাপে কুয়াশার মাত্রাবৃদ্ধি , প্রকৃত ধূসর জ্ঞানে, প্রাণে


এখন দিনগুলো যায় আহা যেন না-শোনা সঙ্গীত
প্রতিদিন কষ্ট পায় সুরগুলো এলোমেলো তানে

এখন দিনগুলো যায় আহা যেন বিদগ্ধ পিরিত
কাটাছেঁড়া করে শুধু নিজেকে ও প্রেমকে, ব্যাখ্যানে।


No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না  যে পিতা সন্তানের লাশ সনাক্ত করতে ভয় পায় আমি তাকে ঘৃণা করি- যে ভাই এখনও নির্লজ্জ স্বাভাবিক হ...

পাঠক-প্রিয়