কুয়াশা যখন
ছোটবেলার নানান বিভীষিকার অন্যতম ছিল কুজ্ঝটিকা বানান। আমরা, যারা, বাক্সের
বাইরে ভাবার জন্যে প্রসিদ্ধি পেয়েছিলাম,তাদেরই কেউ হয়তো বানিয়েছিল এর
সন্ধিবিচ্ছেদ- ক+ু+ ঝটপট+ ট+ই+কা! তাতে অবশ্য পরীক্ষার খাতায় কোন সুফল মেলেনি,
কিন্তু আমরা বিলক্ষণ বুঝে গিয়েছিলাম যে এই কুজ্ঝটিকা, যার ডাক নাম কুয়াশা, ভয়ঙ্কর
গোলমেলে জিনিস। এর কত কত বছর পরে দেখলাম
কবি ও চিত্রকর শ্যামল জানা একটা আস্ত কবিতার বই লিখে ফেলেছেন- কুয়াশা নামক মেয়েটি।
‘তুমিতো সবটা, অর্ধেক যদি
আমি
পিছন ফিরেই কুয়াশার মত
নামি
কুয়াশা তোমার নাক-মুখ-চোখ
কই
আমি মেঘেদের আদরের মেয়ে
হই’ (কুয়াশা নামক মেয়েটি)
‘কুয়াশা-লাগা ভিন্ন দুটি হাতে সুরা নেমে এল
তারপর কী হল জানিনা! শুধু জানি
ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল একটি পলক
সেই ভাঙ্গাচোরা পলকের ভেতর দুজন
পাশাপাশি স্থির, বিবরণহীন দুটি পাথরের আগুন!’ (স্পর্শ)
চূর্ণ রোদ, ফোঁটা ফোঁটা মৃত্যু পড়ে আছে
অসময়ে কুয়াশা আসে, ঢাকে গাছ, ফুল নেই গাছে(একবিংশ শতাব্দী)
কেমন হাড় হিম হয়ে যায় এ কবিতার কাছে এলে। ওই যে ভাঙাচোরা পলকের ভেতর দুজন,
পাশাপাশি স্থির, বিবরণহীন দুটি পাথরের আগুন’- এই ক্রম-বিচ্ছিন্নতা আমাদের গ্রাস করে।
কখনো যে খুব খুব নৈকট্যেও কুয়াশা ঘনিয়ে আসে, দেখা যায় না পাশের মানুষকে- এ বুঝি
সেই বিপন্নতার ছবি। অথচ এই কুয়াশা ভেঙ্গেই তো দেখা হয়েছিল অমিত লাবণ্যের।শিলং
পাহাড়ের কুয়াশার আড়ালে লাবণ্য অমিতের প্রেম সঞ্চার। ছদ্ম কুয়াশা সৃষ্টি করে ঋষি পরাশর মিলিত হয়েছিলেন ধীবরকন্যা
সত্যবতীর সঙ্গে, জন্ম হয়েছিল কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের।
কবি যতই বলুন ‘তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা
করি উদ্ঘাটন সূর্যের মতন’ কিংবা ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ সিনেমায় কুয়াশা কেটে কাঞ্চন জঙ্ঘা উঁকি মারার দৃশ্য যতই
আইকনিক হোক না কেন, আমরা কি সবসময় দেখতে
চাই সত্যের মুখ? বা দেখতে পারি? কৃষ্ণ
দ্বৈপায়ন যিনি বেদকে ভাগ করে বেদব্যাস নামে খ্যাতি পেলেন, তিনি নিজে কুয়াশার আড়ালে
জন্মেছেন বলে, তাঁর সৃষ্ট প্রধান চরিত্রগুলির জন্মকথায় নিয়ে এলেন কুয়াশা। কর্ণ ও
পঞ্চপাণ্ডব –কুন্তী ও মাদ্রীর এই ছ ছেলের জন্মই বেশ রহস্যাবৃত, তাদের প্রকৃত পিতার
পরিচয় জানা যায় না। অগ্নিসম্ভবা দ্রৌপদীরও তাই। আর পুরুষোত্তম কৃষ্ণের জন্ম থেকে মৃত্যু - সমস্তটাই
তো গাঢ় কুয়াশায় ঢাকা।
কুয়াশার মধ্যে কোথাও যেন ছলনা রয়েছে।
‘তোমার সৃষ্টির জাল রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনাজালে
হে ছলনাময়ী’
এর বিপ্রতীপে আছে অন্তরের পথ, যা চিরস্বচ্ছ।
আর ছলনার আর এক নাম যে নারী তা তো পুরুষ কবিরা বলে বলে হদ্দ হয়ে গেছেন।
পুরুষের চোখে নারী কি খুব রহস্যময়ী? কিছুই স্পষ্ট করে বোঝা যায় না?
‘বুঝতে নারি নারী কী চায়, কী চায় গো?
মাঝখানে ছেদ কইতে কথা
চাইতে চাইতে মুদে পাতা
হাসতে হাসতে কেঁদে ফেলে
আসতে কাছে ফিরে যায়’
কুয়াশা এবং নারী-দুয়েরি যে রহস্যম্যতা আছে তা প্রথম বোঝে বাংলা সিরিয়াল। একটা
সিরিয়াল হত। তার নাম কুয়াশা যখন। বাংলা মেগাসিরিয়ালের আদি যুগে। প্রথম দৃশ্যে কুয়াশার বুক চিরে যাওয়া একটা গাড়ির হেডলাইট। লোকে
খুব দেখত। টি আর পি বেড়েই চলছিল। কারণ শেষ দৃশ্যে একটা ফোন আসত। একটা
মেয়ে ফোন করত কাহিনীর মুখ্য পুরুষ চরিত্রটিকে। তিনি বলতে থাকতেন ‘কে? কে? ‘ অমনি
সবাইকে আকণ্ঠ কৌতূহলে রেখে সিরিয়ালটি শেষ হয়ে যেত। বরাবরই পাশের ঘর থেকে শুনেছি,
তাই আমার সিরিয়ালটির ল্যাজা মুড়ো কিছুই জানা হয়নি, কিন্তু আমিও বেজায় কৌতূহলী হয়ে
পড়ছিলাম। তার নিরসন ঘটল, বহু বছর পরে যখন একটি স্বল্পায়ু পত্রিকায় বাংলা সিরিয়াল
নিয়ে একটি চমৎকার ধারাবাহিক বেরোতে শুরু হল। তাতে ওই চিত্রনাট্যকারকে প্রশ্ন করা
হয়েছিল- কে ফোন করত বলুন তো? সিরিয়াল শেষ হয়ে গেল তবু জানতে পারল না কেউ’ তিনি এর
যা উত্তরে বলেছিলেন তা অতীব ব্যঞ্জনাময়,
‘বিশ্বাস করুন আমি নিজেও জানি না কে ফোন করত। আমাকে বলা হয়েছিল সাস্পেন্স ধরে
রাখতে হবে, নইলে টি আর পি পড়ে যাবে’ বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, আমি, আপনি, আমরা জীবনের
টি আর পি বাড়াবার জন্যে মাঝে মাঝেই কি এমন কুয়াশা তৈরি করি না নিজেদের চারপাশে? সেই যে
কেতকী কুশারী ডাইসনের ‘নোটন নোটন পায়রাগুলি’তে আছে গৃহবধূরা কিটি পার্টি, বাগান
করা- আরও কত কুজ্ঝটিকা তৈরি করে রাখে নিজেদের চারপাশে, নোটন দাশকে দিয়ে সেসব হচ্ছে
না। কুয়াশা তৈরি করতে না পারাও কিন্তু একটা অক্ষমতা। আর যাই হোক, দিল্লির ধোঁয়াশার
চাইতে কুয়াশা হাজার গুণ ভালো, তাই না?
No comments:
Post a Comment