নিশুতিরাতের নেপথ্যজন
♦
জামিলের লগে সাক্ষাত হইলো। চিৎকার দিয়া সে ডাক মারিল, হেই হা-ন্না-ন-ভাই! রিকশার গতি থামিয়ে, সরি, গতি কমিয়ে টাটা ভঙিতে বিদায় নিলো। মনেহয় কলফোনে মেতে ছিল বলে...। কী জানি কোন ভাবনাটি সঠিক ছিল আমার. আপনি কিংবা জামিল লম্বা একটা সেশন করেও নিশ্চিত কোনো সিদ্ধান্ত আমাকে চাপাতে পারেন না।
এভাবেই শুরু হোক গল্পটি।
সরি। বিরতি নিয়া ফেলতেছি।
কেউ যদি আপত্তি তুইলাই বসেন, এইটাতো ভাই আপনের অভিজ্ঞতা, গল্প কন ক্যান?
জবাব আছে। অভিজ্ঞতা দরকারি। এর ছায়াপ্রচ্ছারে গল্পের ব্যাকগ্রাউন্ডে রাখা যায়। নজরকাড়া ব্যাকগ্রাউন্ড তো ছবি তুলতে গিয়াও চান আপনারা।
আরে আপনেতো একেবারে সরাসরিই মাইরা দিলেন। এমন প্রশ্ন চলে আসলে বলতে পারছি, জামিলের সাথে কিংবা একটু আগে রাত একটার দিকে বাড়ি ফিরতি এক রাইজিং কবির সহিত যা ঘটেছে তা একটুও লই নাই। তথাপি যা বলেছি তা-ই দেখেছি ও শুনেছি। আরেকটি কথা সংযুক্ত করি। যা দেখি না শুনি না সেখানেই টিকটিকির মতো লুকিয়ে ঝুলে থাকে কাহিনিটি। সেইটি গল্পে আঠালোভাবে লেগে থাকে।
অনেক লাগালাগিতা নিয়েই আমাদের গল্পযাত্রা।
আমি এবার মিনিট পাঁচেকের জন্য দৃশ্যচিত্রে বা চিত্রদৃশ্যে প্রবেশ নিচ্ছি।
অনুপমের সঙ্গে কথা বলা সাঙ্গ করে দিলো একটা পরিস্থিতি। প্রেক্ষিতে মানুষের উপস্থিতি বিবেচনায় মণি, জুন, জুনের নৈশসাথি যার নাম ভুলে গেছি, অনুপমের চেনাজানা নিপু নামের একজনসহ আরো অন্তত আট দশজনের পরিচিতে পেতে চাইলে উপন্যাসেও ধরবে না যে। গল্পের প্রয়োজনে ওদের কমন কটি টার্ম তুলে ধরি। অগ্রগামিতায় সবাই সহযাত্রি। নিশুতি ঘুরাঘুরির বাতিক আছে কমবেশি। সৃষ্টি ও ধ্বংসের খেলায় অল্পস্বল্প থাকেই তাদের মাতামাতি।
জামিলও কিন্তু একজনা। সে অবিশ্যি আক্ষরিক অর্থেই শিক্ষার্থি। তবে পড়াশোনা পাঠক্রমের বাইরেই অধিক।
ধুরু! আমি কই? যিনি সৃষ্টির নিরিখে স্রষ্টাকেও তালাশ করেন অথবা তালাশি চালান তিনি যদি প্রশ্ন না-তুলতে চান, আপাতত থাক এই পর্যন্তই।
দ্বিতীয় বিরতি শেষ হইবার আগেই আবার আইসা পড়ছি। মাঝখানে আমার বিজ্ঞাপনটা পেশ করছি। জাতীয় পাঠক পরিচর্যা কেন্দ্রে আপনারে স্বাগতম। বাকি অংশ প্রসারিত হবে যবনিকার পরে।
জামিলেই ফিরি। গিয়ে দেখে আসি।
বরফকুচি মেশানো বালতিজলে মগ ডুবিয়ে গোসলশেষে মাইক্রোওভেনে ঢুকানো খাবার গিলে ওটি'র প্যাসেন্টের মতো শায়িত থেকে, না, এভাবে মিলে না। বরং সে লেখাপড়ায় থাকুক। ঘুমাক ভোররাতেই।
যিনি চেখভ-জয়েস-নীটশের গল্প আর কাফকা-বোর্হেস-ক্যামুর গল্প কিংবা বাংলাভাষার মানিক-ইলিয়াস-সুমেনের গল্প আলাদা করেন এবং করেন-না, আমাদের গল্পটি হোক সকলের।
আমি ও জামিল এবং অন্যান্যরা আর আপনারা মিলে কাজটি করি।
ক্যামনে কি! জামিলরা দূরে, আপনারা বাইরে। অতএব একলাই বলি।
জামিল আমাকে রাত একটার দিকে অতিক্রম করে যেতে যেতে রিকশা থেকে ডাকনাম ধরে ডেকে যা বলেনি তা দিয়েই পুনর্বার আরম্ভ করি।
রাতগভীরে যে ঘরে ফেরে লোকে তাকে সংশয়ের চোখে দেখে। অথচ সে তাদের নিকটজন ভেবে তাকিয়ে থাকে। পড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে, যাপনের পৃষ্ঠা উল্টিয়ে।
ও, জামিলরা বেশি হাঁটে শিল্লসাহিত্যের অন্যান্য অলিগলিতে। গল্পতৈরিতে তাদের না-ই রাখি। 'আপনি'রা না-থাকলেই কী!
আমি জেগে রয়েছি। আটটার ট্রেন ধরতে প্রস্তুতি চলবে ছয়টা থেকে। দাঁড়িকাটার সময়টা না লাগতো যদি, আরো শুয়ে থাকা যেতো এপাশওপাশ করতে করতে।
ভাষার তাল কেটে যাচ্ছে বুঝি? একটু থামি। ততক্ষণে যেমনখুশি সাজিয়ে নিন নতুন গল্পটি।
সরি, আমিও পাশেই রয়ে গেছি। বাকিরা মানে রাত্রিকার সহপথচারিরা কে কিভাবে থাকার কথা কেউ জানেন কি?
স্বপ্নে অনুপম আবার চাকরিতে অব্যাহতি নিচ্ছে কিনা, বমিবমি অনুভূতি নিয়ে জুন কর্মস্থলে যেতে পারবে কিনা, নেশার রাজনীতিকে মনি, ঘুমানোর আগে, পেশার চেয়ে কার্যকরি ভেবেছে কিনা আমি জানি না। জানে না নিপু নামের তরুণমানুষটি আর নাম মনে-না-আসা চিন্তাবিপ্লবী ছেলেটি। আপনাদের জানাজানিতে আমার এই গল্পের কী লাভ, কী ক্ষতি!
আচ্ছা, জামিলরে কল দিলে! নাহ। মণি, জুন, অনুপম ও অন্যান্যরা একেএকে ওদের কার্যাবলি নিয়ে আবার চলে এলে কাহিনি বিরাটকায় হয়ে যেতে পারে। নিজেকে আশংকামুক্ত রাখতে গল্পের প্রবেশপথগুলি বন্ধ করে আসি।
কী আশ্চর্যকথা! আরো কয়েকজন লুকিয়ে ছিল যে! কেউ চুপটি করে, কেউ ঘাপটি মেরে, কেউ ওঁৎ পেতে।
এক নং ক্যাটাগরি থেকে প্রথমেই উদীচীর রবিন চুপচাপ এসে ছায়াকরি পোজে দাঁড়িয়ে। সম্মুখ দরজার প্রতিবেশী এই রবিন ভাই আমাকে মধ্যরাতে বেরুতে দেখে অহেতুক প্রশ্ন করেছিল, যান কই এতরাতে?
জবাবে যা বলেছিলাম মনে রাখিনি। হায়, এবার যদি সে তা জানতে চায়!
উঁহু, ছায়াপথে ভেসে যেতে যেতে সে আর্তস্বরে বলে ওঠে, এই মুহূর্তে অনুষ্ঠানসূচি ঘোষণা করেন।
কোত্থেকে উড়ে আসে এক কডলেস মাইক্রোফোন। একলাফে বামহাতে শব্দযন্ত্রটি ধরে নিপুন বলতে থাকে, শুরুতেই দোতারা বাজিয়ে অলৌকিক রাত্রির ইশতেহার প্রকাশ করবেন কমরেড আলআমিন আহমেদ জুন।
মুহুর্মুহু হাততালির পর কমরেড শব্দটি অনুপম সরকার, মনজুরুল হাসান ও নাম স্মরণে-না-আসা দ্রোহদগ্ধ তরুণটির চারপাশে চক্রাকারে ঘুরপাক খেতে লাগলো।
পরাবাস্তবতার ঘেরাটোপ হতে পরিত্রাণ পেতে চোখকান বন্ধ করে চলে যাচ্ছি অন্যত্র।
পলাইতে আর পারতেছি কই! দরবেশি চুলদাড়িতে বোরাকমার্কা কী একটা আসমানি বাহনে চইড়া আমার মাথার ওপরে ঝুলানো একটা শূন্যতার সার্কেলে অবতরণ কইরা চেনাচেনা একজন তরুণ, যারে হাসান জামিলের মতো লাগতেছে, মাথায় টোকা মাইরা জানাইতেছে, আরে ভাই এইটা পরাবাস্তবতা না জাদুবাস্তবতা সেইটাই বুঝতেছি না।
ধুরু, ফ্যান্টাসিও হইতে পারে এই অনুষ্ঠানটি। বলতে গিয়ে বুঝতে পারতেছি, আমিও আছি, অস্তিমানই আছি।
কোথাও কোনো কলাকুশলী নেই। তবু অশ্রুতপূর্ব শব্দময়তা আছে, যদিও তার একটা মানেও দাঁড় করাতে পারতেছি না। দর্শকশ্রোতাও অদৃশ্যমান। তবে করতালিমুখর ব্যাপ্তিশীলতা ক্রমসম্প্রসারিত হয়ে যাচ্ছে যা ধারণ করতে চাইছি না আমি।
বিপন্ন সত্তাকে, সম্ভবত সহায়ত্ব প্রদান করতে,
ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে মিশে এগিয়ে আসছে কোনো এক নেপথ্যজন।
ধন্যবাদ
ReplyDeleteভাষায় বাঁকবদলের প্রয়াস
ReplyDelete