বিদগ্ধ কুয়াশার পৃথিবী : কবিতা, দর্শন ও নিরাশার অস্তিত্বময় জীবন
'Jag är inte tom, jag är öppen'-- সুইডিশ ভাষায় রচিত এই লাইনটার অর্থ হল 'আমি শূন্য নই, আমি উন্মুক্ত' । কথাটি লিখেছিলেন আজ থেকে বছর আটেক আগে ২০১১ সালের নোবেলজয়ী বিখ্যাত কবি টোমাস ট্রান্সট্র্যোমার, যাঁর সম্পর্কে নোবেল কমিটি বলেছেন : Because through his condensed, translucent images, he gives us fresh access to reality. ট্রান্সট্র্যোমারের জন্ম ১৯৩১ সালের ১৫ই এপ্রিল, স্টকহোল্মে, গোস্টা ও হেলমি ট্রান্সট্র্যোমারের একমাত্র সন্তান ছিলেন তিনি । মাত্র তিন বছর বয়সেই তাঁর পিতামাতার মধ্যে ঘটে যায় বিবাহবিচ্ছেদ । একটা অসুখী বিয়ের ফসল হয়ে শিশু ট্রান্সট্র্যোমারের জীবন শুরু হল । সেই জীবন হয়ে উঠল আরও বিধ্বংসী, যখন মাত্র ১৭ টি কবিতা নিয়ে ১৯৫৪ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হল । ১৯৫৮ সালে মনিকা ব্লাড নামে এক তরুণীর প্রেমে পড়ে তাঁকে বিয়েও করলেন । জন্ম নিল তাঁর দুই কন্যা সন্তান : ইলা ও পউলা ট্রান্সট্র্যোমার । এরপর থেকেই টোমাসের জীবনের আসল কাজ শুরু হল । ইতিমধ্যে নৈরাশ্যবাদের দর্শন নিয়ে পৃথিবীর বুকে হাজির হয়েছেন শোপেনাহায়ার, হেইডগার, হেগেল থেকে শুরু করে অনেক দার্শনিক । অবশ্য ১৯৬০ সালে ট্রান্সট্র্যোমার রক্সটনায় বন্দি যুবকদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে কাজ শুরু করেন । ১৯৬২ সালে ২১টি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত তাঁর অপর কাব্যগ্রন্থ 'অর্ধ-সমাপ্ত স্বর্গ' । এরপর তাঁর আরও আঠাশ বছরের লেখালিখির জীবন চলে, একাধারে তাঁর সাহিত্যচর্চা এবং সেইসঙ্গে জীবন সম্পর্কে তাঁর চিন্তা, দর্শন, এবং লেখাপত্র প্রকাশিত হতে থাকে । কেননা, ১৯৯০ সালে তিনি স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে চিরকালীনভাবে পঙ্গু হয়ে যান ও নিজের বাকশক্তি হারান । কিন্তু সেইবছরই পান 'নিউস্টাড ইন্টারন্যাশেনাল পুরস্কার', যেখানে তিনি মনোনীত হন ১১-তম লরিয়েট হিসাবে । ততদিনে যেসব দিকপাল ব্যক্তিত্বরা এই পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাঁরা ছিলেন : গাব্রিয়েল গর্সিয়া মার্কেজ, ফ্রাঁসিস পজঁ, এলিজাবেথ বিশপ, অক্টোভিও পাস এবং ম্যাক্স ফ্রিস সহ আরও অনেকে ।
ট্রান্সট্র্যোমারের যেসব কবিতার বই পড়েছি, সেসব বইয়ের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছে আমার আলোর গোলক, দিন ও রাত্রি আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে পরস্পরের সঙ্গে, আমি অনুভব করেছি আমার বাড়িঘরগুলো ভাসমান, আমার জীবনের মানুষগুলো নির্বিকার, আমার সম্পর্কগুলোর বন্ধন আমার প্রতি অত্যন্ত শিথিল, এবং আমি এমন এক নৈরাশ্যের শরীরমন নিয়ে জন্ম নিয়েছি যেটা কোনও কৌশল ছাড়াই আমার কাছে হয়ে উঠবে অস্ত্র, এবং আমাকে মুক্ত করবে আর পাঁচটা মানুষের সবুজ থেকে । তাঁর কবিতার আত্মা হল 'বিশাল অজানা' অর্থাৎ দ্য গ্রেট আননোন (The great unknown) । হতাশা কিংবা মানুষের অন্তর্নিহিত চিত্রকল্প নিয়ে এমনভাবে লেখা কি আমার উচিত হবে ? কীভাবে পদক্ষেপ নিতে পারি সেইসব প্রতিধ্বনিগুলো নিয়ে যা আমায় আমন্ত্রণ জানায় নিঃশব্দে ! আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয় স্যুরিয়ালিস্ট কবিদের কথা, তাঁদের লেখা পরাবাস্তবতার অভিঘাতের কথা । আমার স্বয়ংক্রিয়তা ভেঙে পড়ে, দুর্দান্ত গতির ভিতরে আমি হারিয়ে বসি নিজের স্থিতিকে । পূর্ব থেকেই আমি লক্ষ করেছিলাম, যেসব মহান প্রফেটরা পৃথিবীতে তাঁদের কালজয়ী নিদর্শন রেখেছে, বিষাদ ও বেদনা তাঁদের শিল্পের এক অন্যতম নিদর্শন হয়ে উঠেছে, হতাশার নিরবিচ্ছিন্ন কুয়াশা তাঁদের দর্শনকে রূপ দিয়েছে । 'পৃথিবী যেন এক বিরাট হাসপাতাল'-- লিখলেন ট্রান্সট্র্যোমার । লিখলেন, ' আমি অনুভব করলাম সেই ভয়ঙ্করতা, মোটের ওপর যা আমার জন্যে বসে নেই ।'
ট্রান্সট্র্যোমারের বইপত্র পড়ার অনেক আগেই আমি পরিচিত ছিলাম শোপেনহায়ারের নৈরাশ্যবাদী দর্শনের সঙ্গে । প্রকৃত জীবন আবিষ্কার হয় জনপদের কোলাহল থেকে দূরে, সম্পর্কের তিরস্কারে, নিজস্ব বেদনা ঘিরে । শোপেনহায়ারের 'নো ম্যানস্ ল্যাণ্ড' কি সেই একাকী জীবনের স্মারক ? আমি বুঝিনি, কারণ নিজের মধ্যেও খুঁজে চলি সেই দ্বীপ, সেই জলবেষ্টিত ভূভাগ, যার জন্য আগে থাকতেই নির্বাচিত হয়েছে আমার আত্মা । শোপেনহায়ার সেই আত্মারই আগুনে বারুদ যোগ করেছিল । কিন্তু হেগেল পড়ে আমার বিচারবোধ ভাঙতে থাকে । একটা সামগ্রিক সত্তা, চুম্বকের ন্যায় যার বৈশিষ্ট্য ছিল সাহিত্য থেকে তার প্রাণশক্তিকে শুষে নেওয়া, তা ভেঙে গিয়ে পরিণত হয় দুটি পারস্পরিক দ্বিধার আচরণে । স্যুরিয়ালিস্ট চিত্রকল্পগুলোতে আঁকা সেই অপচ্ছায়া, যা মানুষের চিন্তাকে নিয়ে যায় অদৃশ্যে, ফলে তার জায়গা সহজেই দখল করে নেয় শিল্পীর বিষাদগ্রস্ত জীবনের কুয়াশা । হেগেল পড়তে গিয়ে যা উঠে এসেছে, তা হল : পৃথিবীতে এমন কিছুই নেই যার ভিতরকার নিহিত সত্তা শূন্যতা দিয়ে গড়া নয়, যার সমগ্রটাই অস্তিত্ব ও অনস্তিত্ব দিয়ে সৃষ্টি । জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিখ নীৎসেও শূন্যবাদের দর্শনে এনেছেন তাঁর ব্যক্তিগত চেতনা, আত্মজিজ্ঞাসা । এই নিরন্তর টানাপোড়েন থেকে জন্ম নেয় ট্রান্সট্র্যোমারের স্তব্ধতা । এই ইউটোপিয়ার গঠনকে যখনই আমি প্রশ্ন করেছি, বিশ্লেষণ করেছি, অদ্ভুতভাবে আমি লক্ষ করেছি শিল্পের ক্ষেত্রে যে স্পেসীয় ইউটোপিয়া ও ক্ষণস্থায়ী ইউটোপিয়ার সৃষ্টি হয়, তা স্বয়ংসিদ্ধ । তা পৈশাচিক মেডিউসার কোপদৃষ্টির নিষ্পেষণ । এ জাতীয় সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছিলেন ফরাসি দার্শনিক সার্ত্র । হতাশা ও বিষাদ থেকে জন্ম নিয়েছিল তাঁর জ্ঞানচর্চা । আমরা যারা সাহিত্যের পাশাপাশি দর্শন নিয়েও চর্চা করে থাকি, তারা প্রত্যেকেই জানে কাব্যবৈশিষ্ট্যের যে আধুনিকতা ঐতিহ্য সৃষ্টিতে সংশ্লেষিত হয়েছে তা এসেছে বিষাদাশ্রিত জীবনের প্রশ্বাসকে ঘিরে । লেখকের দৃষ্টি, তাঁর আত্মদর্শন, তাঁর প্রাতিস্বিক চেতনা সম্পৃক্ত করেছে সাহিত্যের তুমুল সৃষ্টিগুলোকে । এই হতাশা, এই দুশ্চিন্তার স্বাধীনতার জন্যেই একজন সত্যিকারের লেখক চিরকালই নির্জনতার নির্বাসনে দণ্ডিত, এ কথা মেনে নিতে আমার কখনোই কোনও কষ্ট হয়নি । আমি চেয়েছিলাম সম্পর্কগুলো নিয়ে একটু বাজিয়ে দেখতে, জানতে চেয়েছিলাম সেখানে আমার জীবনের নির্ভরযোগ্য কিছু থাকতে পারে কিনা ! যে দ্বিধা সম্পূর্ণ ক্যাথলিক ধারণায় গড়ে তোলে না মানুষকে, আবার প্রোটেস্ট্যান্ট হতে গেলেও সন্দেহ করে সে কতখানি বিশ্বাসবিরোধী, সেই যুগপৎ আনুগত্য আমায় সেন্টদের অধীনস্থ করে তুলতে পারেনি । আমি বিশ্বাস করতে পারিনি ভার্জিন মেরীতেও । সেটাকে দেখেছি ঈশ্বরের কদর্য যৌনাকাঙ্ক্ষার মধ্যে দিয়ে । হিন্দুত্বে, ইসলামে, বৌদ্ধে, অথবা জৈন সহ অন্য ধর্মের মধ্যেও সেই নরককে প্রস্ফুটিত হতে দেখেছি । একটা প্রচণ্ড সমবেত শক্তি এ সময় আমার মধ্যে প্রবেশ করে । কিংবা বলা ভাল আমি নিজেকে সংরক্ষণ করেছি অন্যের ভিতর সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার হাত থেকে । আমার প্রশ্ন ছিল সেইসব যুগবাহিত রীতির প্রতি, যা আমার ওপর আরোপ করতে চেয়েছিল আমার প্রতিদিনের জীবন । ঈশ্বরের অদ্বিতীয় সত্তা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করি ঐ হতাশার মধ্যে দিয়েই । একজন ঈশ্বর যদি একা হন, কিংবা সর্বশক্তিমান হন, তা হলে কেন তিনি নিজের সেই হতাশা বা শক্তি প্রদর্শনের জন্য একজন হিন্দু বা মুসলবান বা বৌদ্ধ কিংবা নিদেনপক্ষে একজন খ্রিস্টানকে বেছে নেবেন ? তার তো অংশগ্রহণই করা উচিত না মানুষ্যজাতির সিদ্ধান্তের মধ্যিখানে ।
আমি সত্যিকারের বইগুলো পড়ছিলাম, পৃথিবীতে এসে যা আমার পড়া উচিত ছিল । আমি অপচয় করতাম আমার দিনগুলো, লেখাগুলো সব আপনা থেকেই গ্রহণ করত আমার বিষাদের কারণগুলোকে । যদিও অনেক পরে, তবু পরপরই পড়েছি বার্ট্রাণ্ড রাসেলের নিরাশার একগুচ্ছ লেখা, ভয়ঙ্কর সিকোয়েন্স । রবীন্দ্রনাথ কেমন করে কোন্ পথে চালনা করেছিলেন তাঁর দুর্দান্ত বিষাদবেদনা ! আমি ভাবতাম । তাঁর কবিতার ওজন আমার জীবনের ওজনের চেয়ে বেশি, সেসবের মধ্যে ধরা থাকে জীবনের নিগূঢ় আত্মিক সম্পর্ক এবং অন্তর্নিহিত বস্তুসকল ।
ট্রান্সট্র্যোমারের জীবনের পর্যায়ে ফিরি । সাহিত্যকে আমি কখনো জীবনের বাইরে দেখিনি । দর্শনের যেসব চেহারা আমি দেখেছি, এ কথা বলতে পারি না তা আমায় আতঙ্কের ভেতর ছুঁড়ে দিল কিনা ! কিন্তু যে বিষয়ে আমি সুনিশ্চিত ছিলাম, রহস্যময় এই চিত্রকল্পগুলো মিলিত হওয়ার উদ্দেশ্যে আমার ভিতরে চিরকাল দূরত্বশীল থাকত । পরিশেষে দেখলাম তত্ত্বই বেঁচে থাকে সৃষ্টিতে, শিল্প তা চিরকাল বহন করে । ঘটনাগুলো শুধুমাত্র বদলে গিয়ে সময়ান্তরে মারা যায় । ট্রান্সট্র্যোমারের বিখ্যাত একটি কাব্যগ্রন্থ 'দ্য ওয়াইল্ড মার্কেট স্কোয়্যার' বইতে একটি কবিতা 'কালোছবির পোস্টকার্ড' , যে কবিতাটির প্রতিটি স্তবক এগারো মাত্রার (সিলেবল্ ) তিনটি লাইনে এবং একটি লাইন পাঁচমাত্রায় শেষ হয় । যে কবি নির্জনতামুখী, তাঁর অসামান্য অপর একটি গ্রন্থে আমি পাই স্যাফিক(sapphic) শৈলী । আমি বিশ্বাস করি তাঁর 'পোর্ট্রেট নারী' কবিতাটিকে । এই কবিতাটির আগে তাঁর সমস্ত কবিতায় আমি লক্ষ করতাম ল্যাটিন কবিতার প্রভাব, প্রথাগত সুইডিশ ক্ল্যাসিকাল ফর্ম । কিন্তু প্রেমের কাছে তিনি হারালেন সর্বস্ব । এই কবিতায় তিনি ভাঙলেন ঐতিহ্যবাহী সুইডিশ ছন্দ টেট্রামিটার ও পেট্রামিটার, কিন্তু তিনি ভাঙলেন না স্তবকের ক্ল্যাসিকাল প্যাটার্নটা । ইংরাজি অনুবাদে করা বইটা আমি পড়ে ফেললাম পাহাড়প্রদেশের স্তব্ধতায় বসে । আমি বুঝতে পারি, জানা মানুষের ভিতরে কেমন করে খুঁজব তার অজানা অস্তিত্বকে ! টের পাই, অধিকৃত হচ্ছেন এই কবি । আমার পড়াশুনার ঘরে বইপত্রের মধ্যে ধীরে ধীরে এসে জমা হচ্ছে ইংরাজিতে অনুবাদ করা তাঁর কাব্যগ্রন্থ । আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি তাঁর দার্শনিক প্রবন্ধগুলোর বইপত্রের । সন্ধান করে চলেছি তাঁকে নিয়ে সমালোচনা করা বিভিন্ন গ্রন্থের । আসল আলকেয়িককে কখনো অনুবাদের ভাষায় তুলে দেওয়া যাবে না । তবু, কিছুটা দিলাম :
'কোথাও শূন্যতা নেই এখানে আর
কী আশ্চর্য এই অনুভব--- আমি মিইয়ে যাচ্ছি
আর আমার কবিতারা বেড়ে উঠছে
তারা ক্রমশ বাড়তে বাড়তে আমার স্থান নিয়ে নিচ্ছে
তারা আমাকে তাদের পথ থেকে সরিয়ে দিল
আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল আমারই বাড়ি থেকে ।'
আগুনের শীতল শিখায় অনবরত পুড়েছে সেই নারী, আমার ভিতরে যার অবস্থান । সে নৃত্যমুদ্রায় ভয়ঙ্কর প্রশ্নচিহ্ন রাখে আমার কাছে । সারাজীবন আমি তাকে তাড়িয়ে ফিরি, তাকে খুঁজে ফিরি । তার সাধারণ ছায়ার আড়ালে সবকিছুই হয়ে ওঠে এক নতুন ছায়া । ট্রান্সট্র্যোমারের কবিতায় যে 'বিশাল অজানা'র কথা উল্লেখ করেছি একটু আগেই, তা হল এমন এক শক্তি যা আমাদের একইসঙ্গে সৃষ্টি করে ও সংক্রামিত করে । এই 'অজানা' একাধারে আধুনিক মননশীলতার পরিচয় এবং অন্য দিকে সৃষ্টির চরম ঐতিহ্যবাহী । ভারতীয় দর্শনে সাংখ্য ও চার্বাকরাও হয়ে উঠেছিল দ্বন্দ্ববাদের পরিপন্থী ।
যদিও প্রতিটি লেখায় আমার সেই আত্মবিশ্বাস ও হতাশার চিত্রকল্প আমি জাহির করে বেড়াই, তবু আমার সন্দেহ থাকে সমস্ত গভীর বইয়ের প্রতি । সেইসব বই, যা আসলে নিজেরই ভিতরে অমীমাংসিত । সেসব বইয়ের লেখা যা বইটি শেষ হওয়ার পরেই শুরু হয় এবং শেষপর্যন্ত অশেষ থেকে যায় । কিন্তু ট্রান্সট্র্যোমারের লেখায় হতাশার কাঠামোটা ঠিক কেমন ? মনের অভ্যন্তরে মন, দৃশ্যের মধ্যে জেগে থাকা চোখ, বোর্হেসের ভাষায় যাকে বলা যায়, 'Into a music, a murmur of voice, and a symbol', এ কথার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাই তাঁর আত্মজীবনী Memories Look at me : A Memoir বইতে । কেমন সেই বইয়ের লেখা, একটু পড়া যাক ।
"...'My life.' Thinking these words, I see before me a streak of light. On close inspection it has the form of a comet, With head and tail. The brightest end, the head, is childhood and growing up. The nucleus, the densest part, infancy, the first period, in which the most important features of our life are determined. I try remember, I try to penetrate there. But it is difficult to move in these concentrated regions, it is dangerous, it fells as if I am coming close to death itself. Further back, the comet thins out-- that's the longer part, the tail. It becomes more and more spares, but also broader. I am now far out in the comet's tail; I am sixty as I write this."
এভাবেই বেড়ে ওঠে ট্রান্সট্র্যোমারের কবিতা, তাঁর দর্শন, তাঁকে ঘিরে আমার বিষণ্নসন্ধের পড়াশুনো । আমি যত খারাপই থাকি, আমার যতই তলিয়ে যাওয়া থাকুক ব্যক্তিগত সম্পর্কতে, আমার সেই তন্দ্রাচ্ছন্ন নারীর প্রতি যতই থাকুক আমার সংঘাত-প্রতিসংঘাত ও অতর্কিত প্রেমের ঝড়,--- আমাকে শেষ পর্যন্ত কোনও না কোনোভাবে পল্লবময় হতে সাহায্য করেছে তাঁর লেখা, তাঁর যাবতীয় সত্তার স্মৃতিতর্পণ । যে পংক্তি দিয়ে এই লেখা শুরু করেছিলাম, সেই পংক্তির পরিচয় দিই এবার । টোমাস ট্রান্সট্র্যোমার তাঁর 'জীবিত ও মৃতদের জন্য' বইতে 'ভেরমেয়ার'-এর শেষ পংক্তিতে লিখেছিলেন, 'আমি শূন্য নই, আমি উন্মু্ক্ত', 'Jäg ar inte tom, Jäg ar öppen'.
কাকে বলে কবিতা ? এ প্রশ্নের সংশ্লিষ্ট উত্তর দিতে পারে গড়পরতা কবিতা লেখকেরা । কিন্তু কোনও গভীর কবি এ প্রশ্নের উত্তরে কখনো পৌঁছতে পারে না কবিতার নিজস্ব কোনও স্থির সংজ্ঞায় । আর সেটাই একজন কবিকে, একজন দার্শনিককে তাঁর সমসাময়িক কবিতা লেখকদের থেকে পৃথক করে দেয় । এ কথা কখনোই বলছি না একজন সাহিত্যিককে ঝাঁপ দিতেই হবে বিষাদের সাগরে, কিংবা তাঁকে সামিল হতে হবে ধূসর জলের কলরবে । অথবা এও নয় যে সম্পর্কের মধ্যে খুঁজে বেড়াতে হবে গভীর প্রেম যা মহৎ ঘৃণার উল্টোপিঠে রাখা থাকে । এই চিন্তার নিরিখে বেদনা ও ব্যক্তিগত নৈরাশ্যের লেখালিখিতে দুটো শব্দ উঠে আসে : ইল্যুশন এবং ইপিফ্যানি । ইল্যুশন হল স্যুরিয়ালিস্ট ইমেজ এবং ইপিফ্যানি হল চিত্রকল্পের নির্যাস । যার সংমিশ্রন ঘটান যিনি তিনিই হতে পারেন কালোত্তীর্ণ কবি । শিল্পরাজ্যের যোদ্ধা । ট্রান্সট্র্যোমারের শূন্যবাদের কবিতা, নৈশব্দ্যের দর্শন মূলত স্ক্যান্ডিনেভীয় । ডেনিশ, নরওয়েজীয়, সুইডিশ, ফিনো-সুইডিশ ও আইসল্যান্ডিক সাহিত্যই হল স্ক্যান্ডিনেভীয়ান সাহিত্য । চিরশীতার্ত জলবায়ু ও বরফ সেখানে মৃত্যুর প্রতীক । ভোরের কুয়াশার সেখানে তীব্র প্রেমের স্মৃতিচিহ্ন । গ্রীষ্মের উত্তাপহীন আলো ও স্পন্দনহীন রোদ সেখানে জীবনের দৃষ্টান্ত । বেলমান, কার্লফেল্ড, ওয়েস্টারলিং, মামবার্গ, বোয়ে সহ অনেক সুইডিশ লেখকের কথা বিশ্ব সাহিত্যের পাঠকেরা জানে । এইসব সমস্ত স্বশিক্ষিত লেখকেরা শ্রমজীবীদের জীবনকে কেন্দ্র করেই সাহিত্যচর্চা করেছেন । কিন্তু সুইডেনের সেই প্রলেতারিয়েত সাহিত্যের ধারা ভেঙে ট্রান্সট্র্যোমার নিয়ে এলেন বিদগ্ধ একাকিত্বের সাহিত্য, যেভাবে ফুলের অন্ধকারে সৃষ্টি হয় পরাগযোগের আকর্ষণ, অনিবার্য অনিশ্চিতি ।
ReplyForward
|
No comments:
Post a Comment