নৈঃশব্দের কুয়াশা,সে
তো খোলা
আকাশের নিচে পাখিদের ডানার ছায়ার ম্যাজিক...
‘বাউকুমটা বাতাস
যেমন ঘুরিয়া ঘুরিয়া মরে
সেই মতন মোর গড়ির
চাকা পন্থে পন্থে ঘোরে রে
ও কি গাড়িয়াল মুই
চলং রাজপন্থে’
১।
কুয়াশায় ডুবে
থাকা,কুয়াশায় ডুবে মরা অন্ধকার এক রাত্রীকাল।আকাশ জুড়ে হাড়ির কালির মত ‘হাড়িয়া
ম্যাঘ’।বজ্রবিদ্যুতের গম্ভীর গর্জন।কেমন একটা অলৌকিকতা যেন পরিসর জুড়ে।কালাম
ব্যাপারী বড় গঞ্জ থেকে হাট সেরে ফিরে আসছেন।তার গরুর গাড়ির গাড়োয়ান হাকিমুদ্দিন
গান ধরেছেন,সেই কত কত পুরাতন লোকগান।গানের ওঠানামায় কেমন এক জাদু।রহস্য।গান চলতে
থাকে।গান গড়াতে থাকে।নৈঃশব্দ জমাট হতে হতে কালাম ব্যাপারীর তিন কুড়ি সাত বয়সী
শরীরের বাঁকে বাঁকে কি এক শিহরণ বুঝি বুলিয়ে দিতে দিতে ব্যাপারীকে তীব্র
স্মৃতিকাতরতায় নিমজ্জিত করে দিতে থাকে।ব্যাপারীর দীর্ঘ যাপনের কোন গুপ্ত কোটর থেকে
বেরিয়ে আসা স্মৃতি তাকে কুমারসাহেবের সেই বাঘশিকারের ঘটনাক্রমের কথাই মনে করিয়ে
দিতে থাকে হয়তো বা!এইসব তো আসলে স্বপ্নের মতন।ম্যাজিক বাক্স থেকে উড়ে আসা রুমালের
মতন।আর এভাবেই তো নৈঃশব্দ আর কুয়াশা ঘিরে রাখে মানুষের আবহমানের জীবনকে।
২।
আর তিন বুড়ি গোল
হয়ে নাচে।মাঠে মাঠে,পাথারবাড়িতে নাচ আর গান সাজাতে সাজাতে কুয়াশা ডিঙিয়ে কেবল ভেসে
আসে গান_
‘ও জীবন রে
জীবন ছাড়িয়া না
যাইস রে’
তখন মরিচের খেত
থেকে কি এক ব্যাকুলতা নিয়েই উড়ে যায় অগনণ লাল টিয়া।রুপসীর জমিদারবাড়িতে নাচতে থাকা
ময়নামতি আবো প্রবল নৈঃশব্দ নিয়েই ছুটে যেতে থাকে আসারীকান্দির দিকে।বগরীবাড়ির
দিকে।বালাকুঠির দিকে।আর ময়না মতি দেখতে পান টোকন ব্যাপারীর হাতি শুড় তুলে অভিবাদন
জানাচ্ছে লালজি রাজাকে।আর সেই হাতির সামনে শরীরে সামান্য নাচের মুদ্রা মেখে গান
গেয়েই চলেছে বুচুসুন্দরী।আর সেই গান থেকেই তো নেমে আসতে থাকে দিক ও দিগরের দিকে এক
আশ্চর্য নৈঃশব্দতা_
‘ধওলি মোর মাই
সুন্দরী মোর মাই
দোন জনে যুক্তি
করি
চল পালেয়া যাই’
৩।
শব্দ ও নৈঃশব্দ
নিয়ে,কুয়াশায় কুয়াশায় এভাবেই চিরকালীন বেঁচে থাকতে হয় মানুষকে।অথচ মানুষ
বেঁচে থাকে কেন!এই দার্শনিক জটের ভিতর ঢুকে পড়তে পড়তে আমাদেরকে দেখে ফেলতে হয় আবহমানের
এক চলমানতাকে।সেখানে হাকিমুদ্দিন গাড়িয়ালের গান তখন বাউকুমটা বাতাস থেকে সরে এসেছে
নাল টিয়ার দিকে।আর শিকারজুলুস থেকে কালাম ব্যাপারীর স্মৃতি ঝুঁকে পড়ে জমি ও চর
দখলের অতিজীবিত আখ্যানের উপরেই।এইভাবে নৈঃশব্দ ঘন ও গহীন হয়।এবং নৈঃশব্দ ডুবে মরতে
থাকে সেই চোরাবালিতে হাতি ডোবার এক কালখন্ডেই।এতসবের ফোকড়ে কখন বুঝি প্রবেশাধিকার
পেয়েই যায় গান_
‘বটবৃক্ষের ছায়া
যেমন রে
মোর বন্ধুর মায়া
তেমন রে’
আদতে,কুয়াশা তো
একটা ঘোর!এক তীব্র সবুজ মায়া...
No comments:
Post a Comment