Monday, December 16, 2019

গদ্য- গৌরাঙ্গ শ্রীবাল




কুয়াশায় ভেসে যাওয়া ধোঁয়াশার জীবন



গর্ভের ভারে ঝুঁকে পড়েছে হেমন্ত ধানের গাছ। গ্রামীণ শাঁখের ধ্বনি শুনে ঘুম থেকে জেগে ওঠে তারা দিনের প্রথম স্নান সেরে নিচ্ছে শিশিরে। এমনই বাসি কাপড়চোপড় ধোয়া অভ্যাস গ্রামের বউদের। সংসারের সমস্ত কাজে শুদ্ধতার মনোনিবেশ। তখন তাদের লোকলজ্জা ঢেকে দেয়  হেমন্তের ভোরের পাতলা কুয়াশা। হেমন্তের মাঠ থেকে মরে যেতে যেতে পৌষের কাছে এসে গাঢ় হয়, এবং মাঘের শেষে ফিকে হতে হতে ফাল্গুনের বনে বাসন্তী রঙের ওড়নার মতো উড়তে উড়তে হারিয়ে যায় চৈত্রের বাতাসে।
     কথায় কথায় যে হিমের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে তার জন্ম আশ্বিন-কার্তিকে। শরতের শেষ, হেমন্তের শুরু। হিম অর্থে শীতকাল, তুষার, শিশির। শীতকাল কুয়াশার দিন। শিশিরের ফোঁটা বাতাসে ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হয়ে আরও সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কণায় জন্ম নেয় কুয়াশা। কুয়াশা কখনও কখনও এমন গাঢ় ঘন হয় যে সামনের সমস্তকিছুই থাকে অদৃশ্য। চেনা যায় না কাছের, অতি কাছের মানুষটিকে। মনের ঘাতপ্রতিঘাত, ভালোমন্দের দ্বন্দ্বের সঙ্গে কুয়াশার খুব ভাব। ব্যক্তিত্বে আঘাত লাগা ব্যক্তির কাছে তার পরিচিত মানুষের হৃদয় কুয়াশার মতো অস্পষ্ট। এই অস্পষ্টতার ভিতর দিয়ে ভূতের মতো লাল, নীল, হলুদ আলো জ্বেলে এগিয়ে আসে ভোর অথবা রাতের গাড়ি। ছিঁচকে চোরের কাছে কুয়াশা একটা প্রাকৃতিক আড়াল। যখন তার বামাল নিয়ে দ্রুত লুকিয়ে যাওয়ার পক্ষে সহায়ক।
   কুয়াশার সঙ্গে কৃষিজীবী মানুষের সম্পর্ক গভীর। হেমন্ত ধান, সবুজ শাকসবজি, ফুলের সৌন্দর্যের সময়। হালকা কুয়াশা যেমন ফসলের শ্রীবৃদ্ধির পক্ষে ভালো, তেমনই ভারী কুয়াশা ফসলের অনেক ক্ষতির জন্য দায়ী। জীবনযাপনের মধ্যেও হালকা ও ভারি কুয়াশার প্রচ্ছন্ন প্রভাব বর্তমান। হালকা কুয়াশা জনজীবনে আনে একটা আমেজ, ভারী কুয়াশার মধ্যে ঘুরে বেড়ায় অসুখবিসুখের জীবাণু। তবুও খুব ভোরে উঠে কুয়াশার চাদর গায় জড়িয়ে কৃষিকাজের জন্য হাঁটতে হাঁটতে মাঠে যায় গ্রামের নারীপুরুষ। বেঁচে থাকার একটা অদম্য মায়া, টান। জীবনকে ভালোবেসে যে বেঁচে আছে তা নয়। এই ঘর, এই সংসার, ফসলের ঘ্রাণ তাদের বাঁচার গল্প বলে অবিরাম। এরকম করুণার গল্প শুনে আমার মতো একটি কিশোরের কৃষক বাবা, কাকা, দাদু ভোরের কুয়াশায় কখন যে বিছানা ছেড়ে উঠে চলে যেত সে বুঝত না। যখন ঘুম ভাঙত, দেখে দাদু কিংবা কাকার মাথায় একআঁটি দীর্ঘ ধানের গাছ। সে দীর্ঘতা ছাড়িয়ে যেত তার সমস্ত উচ্চতা। ঠিক সেই সময় হেমন্তলক্ষ্মীর ঢাকা নয়নের মতো কপালের নীচে ঘোমটা টেনে উঠোনের নরম রৌদ্রে দাঁড়িয়ে শাঁখ বাজাচ্ছে কখনও মা, কখনও ঠাকুমা।
     একসময় দেখা যায় কুয়াশার ভিতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে গ্রামান্তের সিউলি। যারা আরও কোনও দূরান্ত থেকে এসে বেঁধেছে খেজুর পাতার অস্থায়ী ঘর। সেটা ঠিক ঘর নয়, কুঁড়ে। তাদের কাঁধে বাঁকা বাঁশের বাঁক। বাঁকের দু-প্রান্তে দড়ি দিয়ে ঝোলানো কয়েকটি মাটির হাঁড়ি। চলাক চলাক করে খেজুরের কাঁচা রস। বুকের সমস্ত রস নিংড়ে দিতে দিতে মেয়েদের মতো গ্রামের বনজঙ্গলের খেজুর গাছগুলি উজাড় হতে বসেছে প্রায়। যে দু-একটি আছে তাদের লিকলিকে ডাঁটার পাতা থেকে ঝরে পড়ে ফোঁটা ফোঁটা শিশির, মনে হয় তারা কাঁদছে বুকের ব্যথায়। কারণ খেজুর গাছের রস আসে বুক থেকে। শুধু খেজুর গাছ নয়, যেকোনো রসের উৎস বুক, হৃদয়। সিউলির বাঁকে ঝোলা হাঁড়ির মতো সময়ের কাঁধে ঝুলে ঝুলে চলছে জন্ম ও মৃত্যু। কোনোদিকের ভার বেশি হলে হারিয়ে যায় দেহের ভারসাম্য, চলার ছন্দ, জীবনের সত্য। জন্ম যেমন সত্য, মৃত্যুও তেমন সত্য। এই সত্য কুয়াশার মতো এতখানি অস্পষ্ট না হলেও ফেলে দেয় একটা ঘোরের মধ্যে।
     খেজুরের রস আগুনে জ্বলেপুড়ে মরতে মরতে যখন গাঢ়ত্বলাভ করে তখন ঘনিয়ে আসে পৌষমাসের সংক্রান্তির মহালগন। একদিকে পাপমুক্তির জন্য গঙ্গায় পুণ্যস্নান, অন্যদিকে পুলিপিঠের সুমিষ্ট গন্ধ। গৃহস্থের দরজার কাছে হাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকে ঈশ্বরের দলিত সন্তান। যারা সারাজীবন কুয়াশায় ঘুরে ঘুরে খুঁজে পেয়েছে এই সত্য, সাগরের জলে হাসতে হাসতে ভেসে যায় সূর্যপূজার ফল এই ফল কোথা যায়? পৃথিবীর সমস্ত জলের সঙ্গে সমস্ত জলের একটা গভীর সুসম্পর্ক। যেমন চোখের জলের সঙ্গে সাগরের জল। উভয়ের স্বাদ নোনা। সব জলই রৌদ্রের স্পর্শে বাষ্পীভূত হয়ে শিশির, শিশির থেকে কুয়াশা। যে কুয়াশার ভিতর দিয়ে সাঁতার কাটতে কাটতে আসে সরস্বতী পূজার হাঁস।
     মাঘমাসের পঞ্চমীতিথি। কথায় বলে মাঘের শীত নাকি বাঘের মতো। কিন্তু বাতাস ঘুরে গেছে বসন্তের পথে। ওপথে দখিনের হাওয়া ঢুকে আরও ঘন করে দিয়েছে কুয়াশার জাল। সেই জাল কেটে পুকুরের জল থেকে উঠে এসে শতরূপার পায়ের কাছে ডানা গুটিয়ে বসে খোঁড়া হাঁস। ভ্যানরিক্সায় চেপে তার আগে পৌঁছে গেছে বাঙ্ময়ী। হাঁস ও তার মালকিন চুপচাপ দেখে কিশোরবেলার কীর্তি। অঞ্জলি দিতে ঠকুরমশায়ের পুষ্পপাত্র থেকে দুটি ফুল নিয়ে যে কিশোর একটি ফুল রেখেছিল হাতে, আর একটি ফুল গুঁজে দিয়েছিল কিশোরীর কিলিপআঁটা মাথার চুলে। লোকে বলে এটা নাকি বাঙালির প্রেমের দিন। অঞ্জলির মন্ত্রের বদলে হয়ত সে বলেছে মোরে আরও আরও দাও প্রেম। তাই বোধ হয় পড়াশুনাটা চণ্ডীপাঠ পর্যন্ত না গিয়ে আটকে আছে জুতো সেলাইয়ে। তবু তো তার হাতে একটা কাজ আছে, যা জীবনের আর্থিক ভিত। আজকের নাম্বারসর্বস্ব জীবন সুদূর-অদূর ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে কী দেখছে! তাদের চোখও কি অশ্রুসজল সামাজিক কিংবা ভক্তিমূলক যাত্রাপালা শুনতে যাওয়া পাড়াগাঁর সাধারণ মানুষের আবেগী চোখের মতো ঝাপসা হয়ে ওঠেনি ব্যর্থতায়! ঝাপসা তো কুয়াশার বৈশিষ্ট্য।
     সারাজীবনের পরিশ্রম দিয়ে সেলাই করা জুতা পায়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখা যায় আঁতুড়ঘরের অস্পষ্ট অন্ধকারে সান্তান কোলে নিয়ে শুয়ে থাকা প্রসূতির মতো আজও কুয়াশার মাঠে শুয়ে আছে প্রসবিনী ধান গাছ। এ শুয়ে থাকা আসলে তাদের প্রতিবাদহীন মৃত্যু। মানুষের পেটে দু-মুঠো ভাতের জন্য তারা তাদের ধান্য-সন্তানগুলিকে খামারে রেখে কৃষকের নিঠুর দা-এর আঁচড়ে মারা গেছে মাঠেই। কিছুদিন পরে হয়ত আর মাঠে মাঠে দেখা যাবে না এ দৃশ্য। কারণটা একপ্রকার মাৎস্যন্যায়। এখানে বড়ো মাছ, ছোটো মাছকে খায় না। সব মাছই দল বেঁধে খেতে আসছে কৃষিজীবী মানুষের চাষের একফসলি, দোফসলি চাষযোগ্য জমি। এর পেছনে কারা আছে তা আর কুজ্ঝটিকার মতো অস্পষ্ট নয়। কুয়াশার আর এক নাম কুজ্ঝটিকা। এমনই এক মাঘমাসের রাতে কুজ্ঝটিকার মধ্যে পড়ে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসের গঙ্গাসাগর থেকে ফেরা এক যাত্রীবাহী নৌকার মাঝিরা দিক ঠিক করতে ভুল করে চলে এসেছিল ‘রসুলপুরের নদী’র কাছে। সেই নৌকার এক বৃদ্ধযাত্রী বাড়িতে চুরির ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে বলেছিলেন,-‘ছেলেপিলে সম্বৎসর কাবে কি’? সেই ভাবনা আজকের বিপন্ন চাষিদেরও। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষগুলো মেছো দালালের পাল্লায় পড়ে চাষের জমি হারিয়ে, হাতের কাজ হারিয়ে, বাতে, পক্ষাঘাতে পঙ্গু হয়ে ঘরে বসে দেখছে ঘনঘোর কুয়াশা। গ্রাস করছে হতাশা।
     কুয়াশাকে আরও জটিল করে তোলে ধোঁয়া। ধোঁয়া ও কুয়াশা একসঙ্গে মিশে তৈরি করে ধোঁয়াশা। ধোঁয়াশা কুয়াশার থেকে ঘন না হলেও একটা জটিল আবর্তের মতো ভেসে বেড়ায় বাতাসে। এ যেন জীবনের দুঃখ, কষ্ট, যান্ত্রণা। প্রতিটি জীবনে কোথাও না কোথাও লুকিয়ে থাকে একটা যন্ত্রণা। তাঁর সঙ্গে মাঝে মাঝে এসে জুড়ে যায় দুঃখ-কষ্ট-ব্যথা-গ্লানি। তখন ভিতরের যন্ত্রণাটা অতিরিক্ত কুয়াশা কিংবা ধোঁয়াশার জটিলতা তৈরি করে নষ্ট করে দেয় হৃদয়ের ফসলোন্মুখ সৃষ্টীশীল সমস্ত সম্ভাবনা। জীবন্মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মানুষ দেখে চারপাশে ধোঁয়াশার অন্ধকার। এই অন্ধকারের ভিতর দিয়ে হাহাকারের মতো ঝরে পড়ে সমস্ত পাতা। ছড়িয়ে পড়ে শুকনো পাতা পোড়ানোর ঝাঁঝালো গন্ধ ভরা আরও একপ্রস্ত ধোঁয়া।
     রোদ উঠলে, বাতাস দিলে একসময় সরে যায় প্রকৃতির সমস্ত কুয়াশা, ধোঁয়াশা। কিন্তু হৃদয়ের ভিতরে যে ব্যর্থতা, গ্লানি, হতাশার কুয়াশা তা একটি সূর্য তো দূরের কথা, হাজার হাজার সূর্যও দূর করতে পারে না, যদি না বসন্তের মতো কেউ এসে বাড়িয়ে দেয় নতুন পাতার হাত। চুরাশি লক্ষ যোনি অতিক্রম করেও বাতাসের দৃষ্টিপথে ভাসমান সেই একই কুয়াশা।

No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না  যে পিতা সন্তানের লাশ সনাক্ত করতে ভয় পায় আমি তাকে ঘৃণা করি- যে ভাই এখনও নির্লজ্জ স্বাভাবিক হ...

পাঠক-প্রিয়