মনের কুয়াশা। কুয়াশার মন।
১।
মাধ্যমিকের টেস্ট
পেপার নিয়ে বসতাম রাত ১১টার পর। তখন নভেম্বর মাস পড়ে গেছে। ডিসেম্বর-ও হতে পারে। মোটমাট, আমাদের মফস্বলে কুয়াশা নেমে আসছে সন্ধ্যার আগেই, এমন একটা সময়। এইটুকুই মনে
রাখা জরুরি। পড়ার টেবিলের
সামনের জানলা সামান্য ফাঁক করে রাখতাম, নইলে আমার ক্লস্ট্রোফোবিয়া চেপে
বসবে বুকে। হাউজিঙ-এর মাঠ
থেকে ভেসে আসত চাপা উত্তেজনা, ব্যাডমিনোন র্যাকেটে প্রিং-প্রিং
ফেদার আদানপ্রদান। এর মধ্যে রামকৃষ্ণ
মিশনের ১৯৯৯ সালের অঙ্কের প্রশ্নপত্র খুলে বসতেই কানে আসত মিহি সুরে শিস। দূর থেকে ক্রমশ কাছে আসতে থাকা 'এই রাত তোমার আমার'। নিখুঁত। বাবুয়াদাদা বড় রাস্তার আড্ডা শেষ
করে হাউজিঙ-এর ক্যাম্পাসে ঢুকলো। রোজ রাতে এই একই গানের শিস দিতেদিতে এক আড্ডা থেকে পরের আড্ডা
পেরিয়ে দু'রাউন্ড ব্যাডমিন্টন পিটিয়ে ঘরে ফেরে বাবুয়াদাদা। আমাদের ফ্ল্যাটের সামনের টিউবওয়েল
এর কাছাকাছি যখন চলে আসে 'এই রাত তোমার আমার', আমি একবার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। বি-৫/৬ এর বারান্দায় শিরশিরে হাওয়া
দেয়। ল্যাম্পপোস্টের
আলোর প্রেক্ষাপটে ভেসে বেড়ায় এলোমেলো কুয়াশার স্তর। তার মধ্যে ঢুকে পড়ছে এই গান। তার মধ্যে ঢুকে পড়ছে হ্যালোজেন
গ্যাসবাতির ডিমের কুসুম রঙের আলো। এই প্রথম আমি নাক টেনে টের পাচ্ছি কুয়াশার ঘ্রাণ। ভেজা, সোঁদা, শান্ত। ক্লস্ট্রোফোবিয়া থেকে পালিয়ে যাওয়ার নির্ভার ঘ্রাণ। বাবুয়াদাদা তখন বেকার যুবক, অ্যাংরি ইয়াং ম্যান। আমাদের থেকে অনেক বড়। চাকরির পরীক্ষা দেয়। এসব কথা বাবুয়াদাদাকে বলার সাহস
হয়নি। বললেই, “পাকামো করিস না” বলে ধ্যাতানি ছাড়া কিছুই জুটবে না কপালে। তবু, বাবুয়াদাদার কাছে আমার ঋণ, সে আমাকে কুয়াশা দেখতে শিখিয়েছে। একটি ডিকন্সট্রাক্টেড ফেনোমেনন
এর মধ্যে কীভাবে একে একে ফিসিক্যাল প্রপার্টি যোগ হয়ে অশরীরী শরীর পায়, শিখিয়েছে গানের শিস, হলুদ আলো আর মফস্বলের হেমন্ত। অথচ, কেমিস্ট্রি বই বলেছে, বাষ্পের রঙ নেই, রূপ নেই, ঘ্রাণ নেই কোনও। আমার মস্তিষ্কে যে সেই কোন আদ্যিকালের রাতে তৈরী হয়েছিল নিউরাল
কানেকশন, কুয়াশার স্মৃতি- অ্যাবস্ট্র্যাক্ট জলীয় আবহাওয়ার সম্পত্তি হয়ে
উঠছিল আমার আজীবনের সম্পদ, তার কথা লেখা থাকবে কোন
বইতে? হয়ত ঠিক এভাবেই ব্রেইনের বিভিন্ন পর্যায়ে বা স্তরে ঘটতে থাকা
নিউরাল কানেকশান ভেসে ওঠে কুয়াশার মত। বিভিন্ন ঘনাঙ্কের ইলেক্ট্রিক ঢেউ মিলেমিশে তৈরী হয় এমন একটি
বস্তু, যাকে আমরা দেখতে পাইনা, ছুঁতে পারিনা। বইতে তার সম্পর্কে
লেখা থাকে, 'এর কোনও আকার নেই।' হয়ত এইভাবেই ইমার্জেন্ট প্রপার্টির
মত গড়ে ওঠে আমাদের মন। মনের কুয়াশা।
২।
ঘুমিয়ে পড়ার পর এক
ধরণের কুয়াশা ওঠে। মাথার ভিতর। ২৫ বছর আগে, অথবা এই গতকাল, তৈরী হয়েছিল যেসব স্মৃতি, তাদের থেকে ধার করা হয় কিছু ছবি, কিছু কথা। হয়ত বা কিছু রঙও, ঠাহর হয়না। এইসব একে একে
ভেসে ওঠে ঘুমন্ত চোখের আড়ালে। পাতলা কুয়াশার মত। ভোরের আলো ফোটার মুহুর্তে শূন্য ধানক্ষেতের
উপর যেমন জুবুথুবু হয়ে থাকে কাঁপা কাঁপা দুধের সর বাতাস। অথবা, দুপুর বারোটার গীর্জার ঘন্টা পড়া মাত্র যেমন পাহাড়, পাকদন্ডী, ধুপি গাছের জঙ্গল আর গুম্ফার আনাচকানাচ থেকে গুলগুল করে বেড়িয়ে
আসে উত্তরবঙ্গীয় কুহেলিকা। সানুতল থেকে দেখলে তাকে মনে হবে অনেক দূরের মেঘ, পাহাড়ের কাছাকাছি বসলে সে ঘরের মেয়ে কুয়াশা। যেমন, জেগে থাকলে এক একটি স্মৃতি অনেক কাল আগের, ঘুমের মধ্যে, সে তো ঘটছে এই, এইমাত্র। অদ্ভূত এক টাইমল্যাপ্স নিমেষের
মধ্যে ঘটিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখি এইসব মুহূর্তে। অবচেতনে স্মৃতিদের ভেসে ওঠা মাখামাখি
ভালোবাসার কুজ্ঝটিকায়। মাথার ভেতরে
কি তাহলে সবসময়েই শীতকাল? নাকি হেমন্ত? হেমন্তের কুয়াশায় অবশ্যই স্বপ্নময়তা বেশি, মায়া আরও গভীর। হেমন্তের কুয়াশায়
জীবনান্দ দাঁড়িয়ে থাকেন পৌষের পূর্বাভাসের মতন। শীতল শান্ত ঘুমের এইখানেই প্রয়োজনীয়তা। ঘুমের অগোচরে একে একে বাঁধা হয়
সেতু। পুরোনো স্মৃতিদের
সঙ্গে নতুন স্মৃতিদের দেখা হওয়ার সেতু। জাগরণে যাদের দেখা হওয়ার সম্ভাবনাই নেই কোনও। বিচ্ছিন্ন দুই ভালোবাসার মানুষের
র্যাপিড আই মুভমেন্ট ঘুমের দোলাচলে এক অনামী ঝুলন্ত সেতুর মাঝবরাবর মিলন দৃশ্য। স্পষ্ট। ঝকঝকে। পাহাড়ের আকাশের মতন। কুয়াশা তাহলে সবসময়ে ঝাপসা নয়। অনিশ্চয়তাই তার একমাত্র ভবিতব্য
নয়। ল্যান্ডস্কেপ
চিত্রে যেমন সামান্য জলরঙ ব্রাশস্ট্রোকে ঘেঁটে যাওয়া কুয়াশাচ্ছন্ন জায়গাটুকুই ক্যানভাসকে
বসিয়ে দেয় পরিচিত মানচিত্রে। ঠিক ঠিক! কার্সেওঙের কুয়াশার মত না? অথবা লখ-লুবনাইগ যাওয়ার পথে যেমন জলের বুক জড়িয়ে ছিল সর্পিল মিহি কুয়াশা। এ তো সেখানকার পাহাড়। মোটেও অ্যাল্পস-এর পাহাড় আঁকা হয়নি। সেখানে কুয়াশা ছিল আরও ঘন। এই স্ট্রোকে সামান্য টাইট্যানিয়াম
হোয়াইট আর ক্যালিয়েন্তে গ্রে মেশালে তবে তা অস্ট্রিয়ান অ্যাল্পস হয়ে
উঠত। শুধু জল আর ফ্ল্যাট
ব্রাশে এই কুয়াশা স্বপ্নেও সম্ভব নয়। এই স্পষ্টবক্তা কুয়াশার দেখা পাওয়া যায় কেবল নিশ্চল ঘুমের ভেতর। ঠিক যদি এই সময়ে চোখের উপর আলো
এসে পড়ে, নড়বড়ে সাঁকো ছিঁড়ে যায়। তার উপর দাঁড়িয়ে থাকা স্মৃতিরা
ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে এদিক ওদিক। অনেক উঁচু থেকে ফ্রি-ফল পেরিয়ে আছড়ে পড়ে দূরে নীচে নিঃশব্দে
গড়িয়ে যাওয়া ফিনফিনে নদীর পাথুরে চরে। থেঁৎলে যায় স্মৃতির অবয়ব। নিরুদ্দেশের তালিকায় নথিভূক্ত
হয় তাদের নাম। কোনও উদ্ধারবাহিনী
তাদের খোঁজ পায়না আর কোনওদিন। বিশেষ বিশেষ খবরে দুর্ঘটনার ঘোষণার মত ঘুম ভেঙে বলতে হয়, “কী যেন একটা দেখছিলাম স্বপ্নে, হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল।“ এই হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়ার আগের
মুহূর্তে মস্তিষ্কে স্নায়ুদের মধ্যে যে নতুন সেতু গড়ে উঠছিল, যা আমাদের ঘুম ভাঙার পরের সবরকম ভাবনাচিন্তার ভিত্তি, স্বাভাবিকভাবে কার্যরত থাকার মূল্যবান রসদ, তাও ভাঙা পড়ল গড়ে ওঠার আগেই।
৩।
একটা স্বপ্ন দেখে
ভয় পাই খুব। বারবার ফিরে
আসে একই স্বপ্ন। প্রতিবার একইরকম
ভয় পাই। মা, বাবাকে জিজ্ঞেস করছেন, “এই মেয়েটা সারাক্ষণ
আমার আসেপাশে ঘুরঘুর করে কেন? ওর নিজের বাড়ীঘর নেই।“ এই কথা শুনে আমি ঘর থেকে বেড়িয়ে
যাচ্ছি। কামেরা জুম-ইন
করছে আমার মুখের উপর, পিছন দিকে আউট অফ ফোকাস হয়ে যাচ্ছেন পাশাপাশি আরাম কেদারায় বসে থাকা মা বাবা। আমার মুখে যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট। স্বপ্নে, এবং স্বপ্নের থেকে বেরোনোর পরেও আমি ভাবি, সবচেয়ে কষ্ট পেলাম কিসে? মা আমাকে ভুলে গেছেন বলে? নাকি বাবাকে মনে রেখেছেন বলে। মনের মধ্যে, বা মাথার মধ্যে যে স্মৃতি তৈরী
হয়, তা কখনও কখনও ঢাকাও পড়ে যায় ঘন কুয়াশায়। তখন সামনে কেবল ধূসর। কোথায় জল শুরু হয়েছে, কোথায় আকাশ, তার মধ্যে কোনও দিগন্তরেখা চোখে পড়েনা। অনন্ত শূন্যতার সামনে দাঁড়িয়ে
আমরা মনে করার চেষ্টা করি এর আগে কী ছিল। এর পরেই বা কী হওয়ার কথা। এর ফাঁকে বাতাসে সামান্য দোলা
উঠলে হঠাৎ চোখে পড়ে আবছা দূরগামী জাহাজ। তাকে তখন কোথায় বসাবো আমরা? তার নীচে যে অতল সমুদ্র, তার মাথার উপরে অসীম আকাশ, তাকে ঘিরে রয়েছে শক্তপোক্ত স্থলভূমি, এসব তখন কুয়াশার কবলে। আমরা তাই জাহাজকে বসিয়ে রাখি কাচের বোতলে, যেখানে কুয়াশার প্রকোপ হয়ত কিছুটা কম। জানলার গায়ে কোহরা জমে জমে ঘষা
কাচ দিয়ে দেখা পৃথিবীর মত অস্পষ্ট হতে থাকে চারপাশ। এর মধ্যে দু'এক ফোঁটা বৃষ্টি জানলা
বেয়ে নেমে এলে কিছুটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে সরু সরু দাগ। সেখানে পরিষ্কার দেখা যায় ওপাশের
বাড়ীর সিকিভাগ চিমনি, চিলেকোঠার রোদে গা এলানো পড়শির হুলো বেড়াল, ভ্যাটিকানের সূর্যাস্ত, ছোটবেলার পেন্সিল বাক্স। পাশাপাশি কোলাজের মত এইসব টুকরো
বসিয়ে কিছুতেই অর্থপূর্ণ মঞ্চ সৃষ্টি হয়না। নৈনিতালের পথে হাঁ করে ভেসে বেড়ানো
কুয়াশা খেতে চেয়ে বারবার ফসকে যাওয়ার বিফলতায় স্মৃতিরা পালিয়ে যেতে থাকে নাগালের বাইরে। চেনা ট্রেকিং পথে অনেক বছর বাদে
ফিরে গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়াতে হয়। রুটম্যাপ যদিও বলছে এখানে একটা এবড়োখেবড়ো পথ উঠে যাবে রডোডেন্ড্রন
ঝোপের মধ্যে দিয়ে, সামনে তখন রাস্তা আটকে দাঁড়িয়েছে রোম্যান্টিক জলীয় বাষ্পের ঘনঘোর। এরপরে তো কিছুই নেই। রুটম্যাপের উপর ভরসা করে এগিয়ে
যাওয়ার সাহসটুকুও নেই। স কিছুকে তুচ্ছ
করে ঘিরে ধরছে গভীর খাদ। আর, ক্ষণিকের বর্তমানটুকু আঁকড়ে ধরে
দাঁড়িয়ে রয়েছে আমার মত দেখতে একটা দ্বীপ। ততদিনে আমরা ভুলে গেছি র্যুম্যাপ কাকে বলে। বৃষ্টি মানে কী? কুয়াশা, তার কী কোনও অর্থ রয়েছে আমার ভাষায়। সেই কোনকালে তৈরী হওয়া কুয়াশার
হলুদ রঙ, স্বতঃস্ফূর্ত ঘ্রাণ, 'এই রাত তোমার আমার', সব ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে অভূতপূর্ব
শীতকালে। ডিমেনশিয়ায়। অ্যালঝাইমার্সে। দু'দিকের শহর, পাহাড়, গ্রাম, নদীর পাড়ের মধ্যে বেড়ে যাচ্ছে
দূরত্ব। যেখানে এককালে
পারাপার করত মানুষ। যেখানে লোহালক্কর
পাথর কেটে তৈরী হয়েছিল প্রাচীন সেতুপথ। সেখানে এই মরশুমে দেখা যায়না কিছুই। যোগাযোগবিহীন ধ্বংসস্তূপের মত
ভেসে বেড়ায় স্মৃতি। রোদ উঠে কুয়াশা
কেটে যাওয়ার ক্ষীণ অপেক্ষায়। যার ওপারে আবার হয়ত কোনওদিন দেখা যাবে পূর্বের কাঞ্চনজঙ্ঘা।
No comments:
Post a Comment