Sunday, December 15, 2019

কবিতা- সুমন মল্লিক






প্র লা প সি ন্ধু১০


জপের মালার মতো গুনে চলেছি হারানো কথাগুলি ৷ গোনা ঠিক হচ্ছে না ৷ তবে এ-গোনা তো গোনা নয় ঠিক, আসলে আনমনে ভাঙা স্বপ্ন বোনা ৷ ফিরে ফিরে যাওয়া না-ফেরার ফরমানে ৷ এক অনন্ত দূরে চলে গেছে চাঁদের আলোমাখা জোনাকিরা ৷ এখন অচেনা লাগে চেনা পৃথিবী ৷ যে পৃথিবীর অর্ধেকে তৃপ্তি, অর্ধেকে তৃষ্ণা ৷ এই যে রাতের মাঝে কিছু রাতের কূজন, এক স্পর্শ থেকে ছড়িয়ে পড়া অগুণতি স্পর্শের মায়া – এসব আমার ইচ্ছে সমেত অপ্রতিরোধ্য ৷

ভাঙনের মাঝে ভাসছে
ব্যাকুল রাতের ফাগুন ৷
          আমার মজ্জায় মজ্জায়
          তোমার স্পর্শের আগুন ৷

উঠোনে আছড়ে পড়া মেঘ আর বুকে আছড়ে পড়া প্রেম আসলে একই ৷ দুটোই তো ভেজায় দেদার ৷ তবু যে প্রেমে কলঙ্কচিহ্নিত ব্যবধান, তার রাখালকে একদিন ঠিক হারিয়ে যেতে হয় আত্মশূন্যে ৷ সেখানে আগুনকে চুমু খেতে খেতে ফিরিয়ে আনা যায় চিরসখীর গায়ের গন্ধ, সানন্দ-স্তন, অমেয় শৃঙ্গার ৷

আকাশজুড়ে তাঁত চালায় স্মৃতি ৷ ভালই লাগে বেশ ৷ তবু কখনও কখনও এই ভাললাগার মাঝে না-ভাললাগাগুলির উৎস চোখের সামনে দিয়ে চলে যায় মৃদু গতিতে ৷ জীবন তো আসলে শত গতির মাঝে এক গতিহীন পাথর ৷ না ভাঙলে মূর্তি, ভাঙলে মখমল পথ ৷ কী নির্ভুলভাবে যে মেপে ফেলি এখন মন থেকে মনের দূরত্ব ৷ কত সিঁড়ির মরিচীকা কলমের ছোট্ট খোঁচায় গয়েব করে দিই সময়ের গা থেকে ৷ নিজের কদর বাড়ে নিজের কাছে ৷ মাঝরাতে লেখা থামিয়ে অঘোরে ঘুমোতে পারি ৷ ফ্যানের দুরন্ত ব্লেডের সাথে বেঁধে দিতে পারি তথাকথিত দেব ও দেবীদের ৷ এসব পারা তো আসলে গনগনে কয়লার ওপর দিয়ে নগ্ন পায়ে হেঁটে চলা ৷ জ্বলনে বিশোক ফলনের সুখ ৷ সুখ তো নিজের ভেতর লুকোনো নিসর্গেই, আর ‘নিসর্গের রূপ মনশূন্য’ ৷

দেয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডারে হিসেব সাজিয়ে রাখছি বৃষ্টি ও কুয়াশার ৷ বুকে দরদ আছে, দরদে প্রজ্ঞা আছে সুমধুর ৷ মুখ বুজে আছি ৷ মাথা একেবারে উঁচু ৷ বলো সজনী, ফেরৎ নেবে, নাকি ফেরৎ দেবে অনন্ত ঢেউ ভরা মোহন ৷

তাড়ন ! একটা উদ্ধত তাড়নকে পাশে বসিয়েই লীন হতে হয় অভাব ও স্বভাবের স্ফুরণে ৷ ইচ্ছের বুনিয়াদের ওপর দোচালা ঘর বানিয়েছি স্বপ্ন, অশ্রু আর অভিশাপে ৷ অনুতাপে শুধুমাত্র মায়ের স্বপ্নভঙ্গ, রমণীর লুকোনো সন্তাপ আর শহর ছেড়ে যাওয়া সহচারিণীর আশ্চর্য স্মৃতি ৷ আঙুল থেকে বেরোনো প্রতিটা অক্ষর এক একটা খঞ্জর ৷ কাগজে আঘাত গুনে রাখি ৷ আঘাতে গুনে রাখি উপলব্ধির অনুরণন ৷ যে অভ্যাসকে অনুসরণ করি তার গর্ভে আমার বুকের উন্মেষ – তৃপ্তি ও অতৃপ্তির সদাবাহার কারুবিন্যাস ৷

আমাকে প্রশ্ন কোরো না কোন ৷ সব উত্তর আমি লিখে রেখেছি মনে বিঁধে থাকা এক একটা আলপিনের ডগায় ৷ সময় যদি পাও কখনও, এসো ৷ বুকের বা দিকে হাত রেখে বুঝে নিয়ো কোথায় তুমি ৷ অথবা চোখে চোখ রেখে দেখো নজর নত হয় কিনা ৷ মনে রেখো, আগুনেই আমার আনন্দ ৷ পুড়তে পুড়তেই একদিন ঠিক মোড়া পেতে বোসবো সমস্ত আরোপের ফুসমন্তরে ৷





প্র লা প সি ন্ধু১১ 

“জলের ভিতরে শুকনা জমি
আঠারো মোকামে তাই কায়েমি
নিঃশব্দে শব্দের উদগামী
               সে মোকামের খবর জান গা যা রে ৷৷”
                                       -- লালন সাঁই

শেষ হয়েও হয় না শেষ ৷ এ কেমন পিপাসা সজনী ! আঙুলের ফাঁক দিয়ে ঝরে যাওয়া বালুজাহানে মুক্ত করেছি মেদুর শ্রাবণ ৷ তবু কেন শৃঙ্খল... মাথুর-প্রবহ ? অথবা মধুর রহস ?

তোমার হঠাৎ আগমনে
জীবিত হয়ে ওঠে অপরাহ্নের আলো ৷

          আমার উড়ে যাওয়া ঘুম ঘেঁষে বসো,
          খুলে রাখো অভিমান
          আর মুগ্ধতাকে আরও মুগ্ধ করে দিয়ে
                 পঞ্চপ্রদীপ জ্বালো ৷

এমনকী সমস্ত সৃজন এখন পাহাড়ি ঝোরার মতো অবাধ্য ৷ ভাঙচুর করে ৷ তবু সেই ভাঙচুরের মাঝে হাত রেখে একটা নিখুঁত পাথর খুঁজি ৷ কবি থেকে ভাস্কর হবো ? তা নয় ৷ কাগজে কলম চালালে কবি, পাথরে খঞ্জর চালালে ভাস্কর ৷ একই ৷ কোন্ শব্দে আমি তোমায় ফিরে পাই সেকথা শব্দেই গোপন থাকুক ৷

মহালয়ার এই বৃষ্টিভেজা সকাল সব প্রশ্ন ভেঙেচুরে দিল ৷ নৌকোয় বসে মেঘলা আকাশ আর হিমেল বাতাসের মাঝে কত কি যে লিখে ফেললাম  ৷ শুধু তোর্সা জানে ৷ পার ভেঙে গেলে নদী বড় হয়, মন ভেঙে গেলে মানুষ ৷ আমি মন ভাঙা ফকির – নিজের একূল-ওকূল খুঁজে পাই না ৷ ভবঘুরে হই, প্রলাপ বকি, পিপাসার বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দেয় আমার স্বপ্নের চোরাবালি ৷ বুকের পৃষ্ঠা সরিয়ে সরিয়ে পেতে চাই তোমাকেই, অসম্ভব ৷ সম্ভাবনা ভেসে যায়... সম্ভাবনা ভেসে যায়... সম্ভাবনা ভেসে যায়...   





No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না  যে পিতা সন্তানের লাশ সনাক্ত করতে ভয় পায় আমি তাকে ঘৃণা করি- যে ভাই এখনও নির্লজ্জ স্বাভাবিক হ...

পাঠক-প্রিয়