প্র লা প সি ন্ধু – ১০
জপের মালার মতো
গুনে চলেছি হারানো কথাগুলি ৷ গোনা ঠিক হচ্ছে না ৷ তবে এ-গোনা তো গোনা নয় ঠিক, আসলে
আনমনে ভাঙা স্বপ্ন বোনা ৷ ফিরে ফিরে যাওয়া না-ফেরার ফরমানে ৷ এক অনন্ত দূরে চলে
গেছে চাঁদের আলোমাখা জোনাকিরা ৷ এখন অচেনা লাগে চেনা পৃথিবী ৷ যে পৃথিবীর অর্ধেকে
তৃপ্তি, অর্ধেকে তৃষ্ণা ৷ এই যে রাতের মাঝে কিছু রাতের কূজন, এক স্পর্শ থেকে ছড়িয়ে
পড়া অগুণতি স্পর্শের মায়া – এসব আমার ইচ্ছে সমেত অপ্রতিরোধ্য ৷
ভাঙনের মাঝে
ভাসছে
ব্যাকুল রাতের
ফাগুন ৷
আমার মজ্জায় মজ্জায়
তোমার স্পর্শের আগুন ৷
উঠোনে আছড়ে পড়া
মেঘ আর বুকে আছড়ে পড়া প্রেম আসলে একই ৷ দুটোই তো ভেজায় দেদার ৷ তবু যে প্রেমে
কলঙ্কচিহ্নিত ব্যবধান, তার রাখালকে একদিন ঠিক হারিয়ে যেতে হয় আত্মশূন্যে ৷ সেখানে
আগুনকে চুমু খেতে খেতে ফিরিয়ে আনা যায় চিরসখীর গায়ের গন্ধ, সানন্দ-স্তন, অমেয়
শৃঙ্গার ৷
আকাশজুড়ে তাঁত
চালায় স্মৃতি ৷ ভালই লাগে বেশ ৷ তবু কখনও কখনও এই ভাললাগার মাঝে না-ভাললাগাগুলির
উৎস চোখের সামনে দিয়ে চলে যায় মৃদু গতিতে ৷ জীবন তো আসলে শত গতির মাঝে এক গতিহীন
পাথর ৷ না ভাঙলে মূর্তি, ভাঙলে মখমল পথ ৷ কী নির্ভুলভাবে যে মেপে ফেলি এখন মন থেকে
মনের দূরত্ব ৷ কত সিঁড়ির মরিচীকা কলমের ছোট্ট খোঁচায় গয়েব করে দিই সময়ের গা থেকে ৷
নিজের কদর বাড়ে নিজের কাছে ৷ মাঝরাতে লেখা থামিয়ে অঘোরে ঘুমোতে পারি ৷ ফ্যানের
দুরন্ত ব্লেডের সাথে বেঁধে দিতে পারি তথাকথিত দেব ও দেবীদের ৷ এসব পারা তো আসলে গনগনে
কয়লার ওপর দিয়ে নগ্ন পায়ে হেঁটে চলা ৷ জ্বলনে বিশোক ফলনের সুখ ৷ সুখ তো নিজের ভেতর
লুকোনো নিসর্গেই, আর ‘নিসর্গের রূপ মনশূন্য’ ৷
দেয়ালে টাঙানো
ক্যালেন্ডারে হিসেব সাজিয়ে রাখছি বৃষ্টি ও কুয়াশার ৷ বুকে দরদ আছে, দরদে প্রজ্ঞা
আছে সুমধুর ৷ মুখ বুজে আছি ৷ মাথা একেবারে উঁচু ৷ বলো সজনী, ফেরৎ নেবে, নাকি ফেরৎ
দেবে অনন্ত ঢেউ ভরা মোহন ৷
তাড়ন ! একটা
উদ্ধত তাড়নকে পাশে বসিয়েই লীন হতে হয় অভাব ও স্বভাবের স্ফুরণে ৷ ইচ্ছের বুনিয়াদের
ওপর দোচালা ঘর বানিয়েছি স্বপ্ন, অশ্রু আর অভিশাপে ৷ অনুতাপে শুধুমাত্র মায়ের
স্বপ্নভঙ্গ, রমণীর লুকোনো সন্তাপ আর শহর ছেড়ে যাওয়া সহচারিণীর আশ্চর্য স্মৃতি ৷
আঙুল থেকে বেরোনো প্রতিটা অক্ষর এক একটা খঞ্জর ৷ কাগজে আঘাত গুনে রাখি ৷ আঘাতে
গুনে রাখি উপলব্ধির অনুরণন ৷ যে অভ্যাসকে অনুসরণ করি তার গর্ভে আমার বুকের উন্মেষ –
তৃপ্তি ও অতৃপ্তির সদাবাহার কারুবিন্যাস ৷
আমাকে প্রশ্ন
কোরো না কোন ৷ সব উত্তর আমি লিখে রেখেছি মনে বিঁধে থাকা এক একটা আলপিনের ডগায় ৷
সময় যদি পাও কখনও, এসো ৷ বুকের বা দিকে হাত রেখে বুঝে নিয়ো কোথায় তুমি ৷ অথবা চোখে
চোখ রেখে দেখো নজর নত হয় কিনা ৷ মনে রেখো, আগুনেই আমার আনন্দ ৷ পুড়তে পুড়তেই একদিন
ঠিক মোড়া পেতে বোসবো সমস্ত আরোপের ফুসমন্তরে ৷
প্র লা প সি ন্ধু – ১১
“জলের ভিতরে
শুকনা জমি
আঠারো মোকামে তাই
কায়েমি
নিঃশব্দে শব্দের উদগামী
সে মোকামের খবর জান গা যা রে ৷৷”
-- লালন সাঁই
শেষ হয়েও হয় না
শেষ ৷ এ কেমন পিপাসা সজনী ! আঙুলের ফাঁক দিয়ে ঝরে যাওয়া বালুজাহানে মুক্ত করেছি
মেদুর শ্রাবণ ৷ তবু কেন শৃঙ্খল... মাথুর-প্রবহ ? অথবা মধুর রহস ?
তোমার হঠাৎ আগমনে
জীবিত হয়ে ওঠে
অপরাহ্নের আলো ৷
আমার উড়ে যাওয়া ঘুম ঘেঁষে বসো,
খুলে রাখো অভিমান
আর মুগ্ধতাকে আরও মুগ্ধ করে দিয়ে
পঞ্চপ্রদীপ জ্বালো ৷
এমনকী সমস্ত সৃজন
এখন পাহাড়ি ঝোরার মতো অবাধ্য ৷ ভাঙচুর করে ৷ তবু সেই ভাঙচুরের মাঝে হাত রেখে একটা নিখুঁত
পাথর খুঁজি ৷ কবি থেকে ভাস্কর হবো ? তা নয় ৷ কাগজে কলম চালালে কবি, পাথরে খঞ্জর
চালালে ভাস্কর ৷ একই ৷ কোন্ শব্দে আমি তোমায় ফিরে পাই সেকথা শব্দেই গোপন থাকুক ৷
মহালয়ার এই
বৃষ্টিভেজা সকাল সব প্রশ্ন ভেঙেচুরে দিল ৷ নৌকোয় বসে মেঘলা আকাশ আর হিমেল বাতাসের মাঝে
কত কি যে লিখে ফেললাম ৷ শুধু তোর্সা জানে
৷ পার ভেঙে গেলে নদী বড় হয়, মন ভেঙে গেলে মানুষ ৷ আমি মন ভাঙা ফকির – নিজের
একূল-ওকূল খুঁজে পাই না ৷ ভবঘুরে হই, প্রলাপ বকি, পিপাসার বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দেয়
আমার স্বপ্নের চোরাবালি ৷ বুকের পৃষ্ঠা সরিয়ে সরিয়ে পেতে চাই তোমাকেই, অসম্ভব ৷ সম্ভাবনা
ভেসে যায়... সম্ভাবনা ভেসে যায়... সম্ভাবনা ভেসে যায়...
No comments:
Post a Comment