কুয়াশার দেশ
থেকেও না থাকা, ডুবেও না ডোবা, ছুঁয়েও না ছোঁয়া অথবা ভেসেও না ভাসাও এক আত্মমগ্ন - যাপন। এসব কুয়াশা জন্মগত। যে দরজাগুলো ভেজানো বলে অন্ধ হতে হতে, বন্ধ থাকতে থাকতে কুয়াশাবৃত হয়ে গেছে, শরীরের যে অঙ্গগুলো আর অক্সিজেন পায়না সেখানে সেখানে এবং মস্তিষ্কের যে কুঠুরিগুলোয় হাসি পৌঁছতে পারেনা, কুয়াশা ঠিক পৌঁছে যায়। কুয়াশা আর আলজোলাম অনেক ভোরে উঠে, হাত ধরাধরি করে হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে বেড়ার ওপারে অদৃশ্য হয়ে যায়। হোঁচট খেতে খেতে এগিয়ে যায় এই নিষিদ্ধ নগরীতে। ফুলকুমারী যখন শীতকালে কুল এনে দিত, মা ওকে পয়সা, চাল, আলু দিলেও, আমি জানতাম ও আসলে পরী... নইলে লাল লাল টোপা কুল যে আমার শীতকালে সবচেয়ে প্রিয় জিনিস, সেটা ও জানবে কি করে? ছোটবেলায় ঘাটশিলায় হারানো আমার নীল রুমালটা এখনো আমার পাশে এসে চুপচাপ শুয়ে পড়ে কুয়াশার দিনগুলোয়, মাঝে মাঝে উঠে চোখের কোণটা দেখে নেয়, চকচক করলেই চুপচাপ চোখ মুছিয়ে দিয়ে আবার ঠায় তাকিয়ে থাকে বাধ্য প্রহরীর মতন।
কুয়াশার দেশ যারা মাথার মধ্যে নিয়ে বড়ো হয়, তাদের বাস্তব আর কল্প-লোকের মধ্যের বাউন্ডারি লাইনটা খুব ক্ষীণ হতে হতে কোথাও মিলিয়ে যায় আবার কোথাও ওভারল্যাপিংও হয়ে যায়।গল্ফ গ্রাউন্ডের শেষের দিকটা যেখানে আকাশে মিশে যাচ্ছে, সেখানে নদী দেখেছি বলে যারা হেসেছিল, তারা এসব নদীদের দেখা কোনোদিন পেলোনা বলে আমি এখন তাদের জন্য দুঃখ পাই।
ঘর আমায় আগলে রাখেনি বলেই হয়ত কুয়াশা তার আঁচলের ছায়ায় বিবিধ ইউ ভি রেজ এর থেকে রক্ষা করে চলেছে। বয়স বাড়লেই উপকূলের ভিজে হাওয়া ভাসাবে মাঝে মাঝে, তার সাথে নিয়মিত ব্যবধানে উলঙ্গ আলোর দোলনা দুলিয়ে দিয়ে যাবে চিত্ত, কুপোকাত হব সেসব অসহিষ্ণু প্রেমে, রোদচশমা পরে পড়ন্ত বিকেলের রোদের রং লিখব সবুজ আর অমনি পাখি তার নিজস্ব নিয়মে একটা ঝোড়ো হাওয়ার শিরশিরানি উপহার দিয়ে চোখের পলকে উভমুখী বিক্রিয়াটিকে একমুখী করে দেবে। প্রজ্জ্বলিত জোনাক-রাতের কাছে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেব সেদিন " এরপর? " সে বলবে " এবার নিজের কাছে ফিরে যাও ।" নিজের কাছে তাহলে ছিলাম না? লাইন চ্যুত ট্রেন বলেই এই দুর্ঘটনা তবে? বেশ, ফেরা যাক অক্ষরে অক্ষরে কুয়াশার দেশে। কুয়াশা লগ্নে জন্ম, কুয়াশা রাশির মেয়ে আমি, শিকড়ের কথা ভুললে চলবে কেন?
রোজ বিকেলে এখন বসে থাকি খেলার মাঠে। সেখানে বন্ধুরা দৌড়োদৌড়ি করে। আমি খেলায় আনাড়ি বলে চুপচাপ গাছের তলায় বসে খেলা দেখি। কারুর পায়ে চোট লাগলে সে আসে, গল্প হয়, কিছু শুশ্রুষা পায়, তারপর আবার সে ভিড়ে মিশে নতুন খেলায় যোগ দেয়। এসব জায়গায় কোনো নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়না। মুঠোফোন এক ঘন্টাতেই কোমায় চলে যায়। সন্ধেবেলায় ডায়রি খুলে বসি।এখানে সব ধরণের ডায়রির মাস্টার কি পাওয়া যায়। যেসব ডায়রি সারাজীবন ধরে জমিয়ে একসময় ছিঁড়ে পুড়িয়ে ফেলেছি, এখানে দরখাস্ত জমা দিলে সেসব ফিরে পাওয়ার চল আছে। স্মৃতি খুব ভারী। লোহা অথবা জল কিছুই নয় তার তুলনায়। তাই বিশেষ ধরণের বুকর্যাকে সেসব এসেন্ডিং অর্ডারে সাজানো থাকে। নেড়েচেড়ে দেখি সব মুখস্থ। শুধু একটা পর্দা ছিল মাঝখানে, সেটা সরালেই ঢুকে পড়ল। পর্দার ওপারেই যেন দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল এতদিন। " কভি কভি মেরে দিলমে " গুনগুন করে উঠতেই তার শাড়ী, গয়না, ওড়নার বাধা টপকে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
ঠাকুমা মারা যাওয়ার আগে, আমাকে আকাশনীল রঙের কাচের মাছকৌটো দিয়ে গেছিল চাবি রাখার জন্য। কি করে যেন বুঝে গেছিল, সারাজীবন অগণিত চাবি হারাতে থাকব আমি। মাছকৌটোটা হারিয়ে গেছে কিন্তু যে দেরাজটা মা এনেছিল, সেটা তার বিশাল বেঢপ ভাঙাচোরা চেহারা নিয়েও আমার সাথে বিভিন্ন বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। মানে নিজে থেকে যে আসে, তাকে চোখের আড়াল করলেই সে হারিয়ে যায় আর ডেকে আনলে তাকে ধরে বেঁধে রেখেও দেওয়া যায় । ভারী মজার ব্যাপার কিন্তু। যদিও আমি আর কাউকে ডাকিনা, আমার নিজের কাছ থেকে নড়ার যো নেই যে এই ভরন্ত নারীবেলায়। পাখি বলেছিল নিজেই সকলে নিজের পরশ পাথর। মোহের বশে নিজেকে অতিক্রম করতে চেয়েছ কি সর্বনাশ ! অন্ধের যষ্টির মতন নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে নিজেকে ছুঁয়ে থাকি স্বপ্নবৎ, দৈবাৎ পার হয়ে যাই লক্ষণরেখা ! এত এত হারিয়েছি অলীক জ্যোৎস্নার বুকে চাল ধোয়া জলের ভোর কিম্বা বিমূর্ত চাঁদের পাশে শায়িত শিশুর দেয়ালার নিঝুম টলটলে আলো, যখনি ডাক দেয় গভীর খাদের সিঁড়ি অথবা জ্বরো দুপুরের অস্ফুট প্রলাপ, সেসব হাতছানিকে "আসছি" বলে আয়ুরেখা পার করে চলে যাই। কোনোদিন আর কক্ষচ্যুত হবনা বলে সাবধানী মন জেগে থাকে নীল পতাকা হাতে আর যাবতীয় বিলোল চাহনি তাদের শীৎকারের আমিষ গন্ধ সমেত চৌকাঠে হোঁচট খেয়ে পরিধির বাইরে এক্কা দোক্কা খেলতে খেলতে রাত জাগে। জোনাকি-চোখ পেঁচা সমস্ত বিয়োগের ভয়ের ওপর বসে ভায়োলিন বাজাতে থাকে।।
No comments:
Post a Comment