Monday, December 16, 2019

'জয় কাবেরীর বই'-- এক আশ্চর্য কাব্যসংসার







'রান্না আর গান একসঙ্গে বয়ে যায়
একদিকে তেল ঝাল মশলা
আর একদিকে সুর তাল লয়।'

কার লেখা এ কবিতা? যদি নাম না দেখি? যদি ভাবি এই কবিতা যার লেখা তিনি এমন একজন কবি, যিনি সংসারের ছোট ছোট বস্তুর মধ্যে, ঘটনার মধ্যে দিয়েই দেখতে পাচ্ছেন বৃহত্তর একটি ঘটনাকে, তাহলে মনে হয় মিথ্যে বলা হবে না। কবিতার একটি সহজ লীলাখেলা আছে। তা যেমন দৈব, যেমন অপ্রত্যাশিত, তেমন-ই তা হাতের কাছেই থাকে। আমাদের পাশাপাশি ঘোরে। আমাদের পাশের চেয়ারে বসে বসে দেখে কীভাবে আমরা হন্যে হয়ে তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। কিন্তু যে পাওয়ার, সে পেয়ে যায়।
কবি কাবেরী গোস্বামীর অন্য যে পরিচয়, তা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। বরং, ভাবা যাক, জেন কবিতা সম্পর্কে কিছু না জানলেও কীভাবে জেন একজন কবির অন্তরাত্মায় প্রবেশ করে যায়। তালপাতা থেকে প্রকাশিত জয় কাবেরীর বই- কাব্যগ্রন্থে এমন কিছু আশ্চর্য কবিতার হদিস আছে, যেগুলি সম্ভবত 'সং অফ ইনোসেন্স' বললেই ভালো হয়। মনে পড়ে যায় উইলিয়ম ব্লেকের কথা অবশ্যই।
সব কবিতা যে সমান মানের তা বলা কখনওই উচিত হবে না। কিন্তু কোনও কোনও কবিতা, কাব্যের শীর্ষদেশ এমন ছুঁয়ে আছে, যেখানে যাওয়া খুব সহজ ব্যাপার নয়। এপিফ্যানির জন্য অপেক্ষা করে নয়, বরং মুহূর্তকে কবিতা করে নেওয়ার এক আশ্চর্য ক্ষমতা আছে কবি কাবেরী গোস্বামীর।
' যখন গিটার দেখি আমি গিটার হয়ে যাই/ যখন সেতার দেখি তখন সেতার হই/ গিটার হয়ে জিমি হেনড্রিক্সের হাতে বাজি/ সেতার হয়ে শাহিদ পারভেজের হাতে'। অথবা আরেকটি কাবেরী গোস্বামীর লেখা জেন কবিতার উদাহরণ- ' নিজেকে সবসময় তৈরি করি এখনও/ ভৈরবী রাগের মতন/ যাতে মধুর থাকতে পারি"।
কিন্তু সমস্ত কবিতাকে ছাপিয়ে গেছে তাঁর এমন একটি কবিতা, যা পড়লে কবিতা লেখার মতো ঘোর এসে হানা দেয়।
কবিতাটি দু লাইনের। কিন্তু পড়ার পরে কবিতাটি ক্রমশ একটি মহাকাব্য হয়ে যায়।

গাছে জবা ফুটে থাকলেই মনে হয়
মা কালী দাঁড়িয়ে আছেন

মাত্র ২৭টি কবিতা নিয়ে জয় কাবেরীর বইয়ের প্রথম অংশ কাবেরী গোস্বামীর লেখা। এক স্বতন্ত্র স্বর, এক স্বতন্ত্র কাব্যভাষা, এক স্বতন্ত্র দৃষ্টি।

দ্বিতীয় অংশ যাঁর লেখা, তাঁর কবিতা সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। তিনি,কবি জয় গোস্বামী। কাবেরী গোস্বামীর অংশের নাম দুগগা দুগগা। আর জয় গোস্বামীর অংশের নাম দৈব।
কিন্তু কেন দৈব?
কবিতা তো আসলে লিখিত হয়।  কবিতা তো লেখেন না কেউ। নিজেকে কবিতার জন্য প্রস্তুত করে রাখতে হয়। এটিই কবির সাধনা।
সূর্য পোড়া  ছাই কাব্যগ্রন্থটি কবি জয় গোস্বামীর একটা সন্ধিক্ষণ। এই কাব্যগ্রন্থ থেকেই জয় গোস্বামী বাচ্যার্থের বাইরে কবিতাকে নিয়ে যাওয়ার দুরূহ লিখনপ্রক্রিয়া শুরু করেন তাঁর কবিতায়। যার উদাহরণ আমরা পাই সূর্য পোড়া ছাই, মৌতাত মহেশ্বর, ভালোটি বাসিব, প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে। কিন্তু এই কাব্যগ্রন্থে যেন একপ্রকার বিবাহ ঘটেছে কবির সহজিয়া মন এবং প্রাজ্ঞ মনের। তিনি যেন বোধির উদ্দেশ্যে সাধনায় বসেছেন সাংসারিক বৃত্তের মধ্যে থেকেই।
কিন্তু ওইযে বাচ্যার্থের থেকে শব্দকে বের করে আনা, তার অন্যথা হয়নি।

প্রথম কবিতার প্রথম কবিতাতেই সেই অনুরণন- দৈব আমার ময়ূর, তার গা ধুয়ে দেয় জল।
আট লাইনের এক একটি কবিতা। তার তিনটি স্ট্যাঞ্জা। প্রথমটি তিন লাইনের, দ্বিতীয়টি তিন লাইনের। এবং তৃতীয়টি সনেটের হিরোইক কাপলেটের মতো দুলাইনের।
তেরজার ফর্মকে তিনি এখানে ভেঙে চুরে ব্যবহার করছেন। কিন্তু সনেটের মতো হিরোইক কাপলেট থাকছে।
ফুলের রঙে দেখি স্বয়ং অপ্রত্যাশিতকে।

একজন কবি আজীবন এই অপ্রত্যাশিতকে দেখার চেষ্টাই করে যান। আর করে উন্মাদ হয়েও যান। তাঁর নিয়তিই হল এই পতঙ্গের মতো আগুনের দিকে ছুটে যাওয়া।

'আমার ঘরে কোন প্রহরী দ্বার খুলে দেয় রাতে? আমরা যেন রবীন্দ্রনাথকে আবার খুঁজে পেলাম। এই কাব্যগ্রন্থের ছত্রে ছত্রে রবীন্দ্রনাথ আছেন, কিন্তু কবি রবীন্দ্রনাথের বিনির্মাণও করেছেন। রবীন্দ্রনাথকে নিজের মতো করে, এই সময়ের মতো করে আবিষ্কার করার এমন অসামান্য কাব্যভাষা আগে পড়িনি।
'দানের কাছেই বসব তবে, কোথাও নেই বাধা
রাত্রি অবসানের তীরে আমার ঘর বাঁধা...

অথবা

কোনখানে কী পা ফেলেছি , পায়ে জড়ায় কাঁটা
কী বিষমধু কী মধুবিষ নিয়ে আমার হাঁটা...

আহা, এই তো কবিতা। এই তো সেই কবিতা যার কাছে এসে দু দণ্ড এসে বসে থাকতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু এখানেও কি জয় কবিতার বাচ্যার্থকে অতিক্রম করে ওঠার কাজটি করলেন না? করলেন। কিন্তু কী নিবিড় ও কী নীরবতায়!

দৈব সম্পর্কে যদি একটা বাক্য বলতে হয় তবে সম্ভবত এই কথাটিই বলব। নিবিড় ও নীরব। অথচ ছত্রে ছত্রে কবিতার অন্তর্ঘাত। অন্তর্ঘাত-ই বলব, কারণ যেমন রবীন্দ্রনাথ খুব সহজ কিছু কথার মধ্যে ঢুকিয়ে দেন অন্তর্ঘাতী সব লাইন, হয়তো বা কিছু চিত্রকল্প, ঠিক তেমন-ই কবি জয় গোস্বামী এখানে কী নিপুণভাবে পাঠককে ভুলিয়ে দেন তিনি আসলে এক মিনিয়েচার পেন্টিং-এর রচয়িতা এই কবিতাগুলিতে।

আসলে ইচ্ছে করে সবকটি কবিতাই তুলে আলোচনা করতে।
কিন্তু সবসময় তা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
একটাই কথা বলার এখানে। দৈব, এক স্বতন্ত্র ধারার জয় গোস্বামীর কবিতা।
হয়তো পরবর্তীকালে এই কবিতাগুচ্ছের বড় কোনও অংশ আমরা দেখব না। কারণ পাঠক হিসেবে আমার মনে হল এই কবিতাগুলি এখানেই শুরু ও এখানেই শেষ।

সামগ্রিক ভাবে বলতে গেলে, জয় কাবেরীর বই এক আশ্চর্য সংসার।
'তোমার সাধারণের পাশে আমার সাধারণ'...


গ্রন্থ- জয় কাবেরীর বই
তালপাতা
প্রচ্ছদ-কঁকতোকে লেখা পিকাসোর চিঠি
১৫০ টাকা


হিন্দোল ভট্টাচার্য 

No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না  যে পিতা সন্তানের লাশ সনাক্ত করতে ভয় পায় আমি তাকে ঘৃণা করি- যে ভাই এখনও নির্লজ্জ স্বাভাবিক হ...

পাঠক-প্রিয়