Monday, December 16, 2019

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে





এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না 

যে পিতা সন্তানের লাশ সনাক্ত করতে ভয় পায়
আমি তাকে ঘৃণা করি-
যে ভাই এখনও নির্লজ্জ স্বাভাবিক হয়ে আছে
আমি তাকে ঘৃণা করি-
যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরাণী
প্রকাশ্য পথে এই হত্যার প্রতিশোধ চায় না
আমি তাকে ঘৃণা করি-
আটজন মৃতদেহ
চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে
আমি অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যাচ্ছি
আট জোড়া খোলা চোখ আমাকে ঘুমের মধ্যে দেখে
আমি চিৎকার করে উঠি
আমাকে তারা ডাকছে অবেলায় উদ্যানে সকল সময়
আমি উন্মাদ হয়ে যাব
আত্মহ্ত্যা করব
যা ইচ্ছা চায় তাই করব।
কবিতা এখনই লেখার সময়
ইস্তেহারে দেয়ালে স্টেনসিলে
নিজের রক্ত অশ্রু হাড় দিয়ে কোলাজ পদ্ধতিতে
এখনই কবিতা লেখা যায়
তীব্রতম যন্ত্রণায় ছিন্নভিন্ন মুখে
সন্ত্রাসের মুখোমুখি-ভ্যানের হেডলাইটের ঝলসানো আলোয়
স্থির দৃষ্টি রেখে
এখনই কবিতা ছুঁড়ে দেওয়া যায়
’৩৮ ও আরো যা যা আছে হত্যাকারীর কাছে
সব অস্বীকার করে এখনই কবিতা পড়া যায়
লক-আপের পাথর হিম কক্ষে
ময়না তদন্তের হ্যাজাক আলোক কাঁপিয়ে দিয়ে
হত্যাকারীর পরিচালিত বিচারালয়ে
মিথ্যা অশিক্ষার বিদ্যায়তনে
শোষণ ও ত্রাসের রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে
সামরিক-অসামরিক কর্তৃপক্ষের বুকে
কবিতার প্রতিবাদ প্রতিধ্বনিত হোক
বাংলাদেশের কবিরাও
লোরকার মতো প্রস্তুত থাকুক
হত্যার শ্বাসরোধের লাশ নিখোঁজ হওয়ার স্টেনগানের গুলিতে সেলাই হয়ে
যাবার জন্য প্রস্তত থাকুক
তবু কবিতার গ্রামাঞ্চল দিয়ে
কবিতার শহরকে ঘিরে ফেলবার একান্ত দরকার।
এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না
এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না
এই বিস্তীর্ণ শ্মশান আমার দেশ না
এই রক্তস্নাত কসাইখানা আমার দেশ না
আমি আমার দেশকে ফিরে কেড়ে নেব
বুকের মধ্যে টেনে নেব কুয়াশায় ভেজা কাশ বিকেল ও ভাসান
সমস্ত শরীর ঘিরে জোনাকি না পাহাড়ে পাহাড়ে জুম
অগণিত হৃদয় শস্য, রূপকথা ফুল নারী নদী
প্রতিটি শহীদের নামে এক একটি তারকার নাম দেব ইচ্ছে মতো
ডেকে নেব টলমলে হাওয়া রৌদ্রের ছায়ায় মাছের চোখের মত দীঘি
ভালোবাসা-যার থেকে আলোকবর্ষ দুরে জন্মাবধি অচ্ছুৎ হয়ে আছি-
তাকেও ডেকে নেব কাছে বিপ্লবের উৎসবের দিন।
হাজার ওয়াট আলো চোখে ফেলে রাত্রিদিন ইনটারোগেশন
মানি না
নখের মধ্যে সূঁচ বরফের চাঙড়ে শুইয়ে রাখা
মানি না
পা বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা যতক্ষণ রক্ত ঝরে নাক দিয়ে
মানি না
ঠোঁটের ওপরে বুট জ্বলন্ত শলাকায় সারা গায় ক্ষত
মানি না
ধারালো চাবুক দিয়ে খণ্ড খণ্ড রক্তাক্ত পিঠে সহসা আ্যালকোহল
মানি না
নগ্নদেহে ইলেকট্রিক শক কুৎসিৎ বিক্রত যৌন অত্যাচার
মানি না
পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা খুলির সঙ্গে রিভলবার ঠেঁকিয়ে গুলি
মানি না
কবিতা কোন বাধাকে স্বীকার করে না
কবিতা সশস্ত্র কবিতা স্বাধীন কবিতা নির্ভিক।
চেয়ে দেখো মায়কোভস্কি হিকমেত নেরুদা আরাগঁ এলুয়ার
তোমাদের কবিতাকে আমরা হেরে যেতে দিইনি
বরং সারাটা দেশ জুড়ে নতুন একটা মহাকাব্য লেখবার চেষ্টা চলছে
গেরিলা ছন্দে রচিত হতে চলেছে সকল অলংকার।
গর্জে উঠুক দল মাদল
প্রবাল দ্বীপের মত আদিবাসী গ্রাম
রক্তে লাল নীলক্ষেত
শঙ্খচূড়ের বিষ-ফেনা মুখে আহত তিতাস
বিষাক্ত মৃত্যুসিক্ত তৃষ্ণায় কুচিলা
টণ্কারের সূর্য অন্ধ উৎক্ষিপ্ত গাণ্ডীবের ছিলা
তীক্ষ্ম তীর হিংস্রতম ফলা-
ভাল্লা তোমার টাঙ্গি পাশ
ঝলকে ঝলকে বল্লম চর-দখলের সড়কি বর্শা
মাদলের তালে তালে রক্তচক্ষু ট্রাইবাল টোটেম
বন্দুক কুরকি দা ও রাশি রাশি সাহস
এত সাহস যে আর ভয় করে না
আরো আছে ক্রেন, দাঁতালো বুলডজার বনভয়ের মিছিল
চলামান ডাইনামো টারবাইন লেদ ও ইনজিন
ধ্বস-নামা কয়লার মিথেন অন্ধকারে কঠিন হীরার মতো চোখ
আশ্চর্য ইস্পাতের হাতুড়ি
ডক জুটমিল ফার্ণেসের আকাশে উত্তোলিত সহস্র হাত
না ভয় করে না
ভয়ের ফ্যাকাশে মুখ কেমন অচেনা লাগে
যখন জানি মৃত্যু ভালোবাসা ছাড়া কিছু নয়।
আমাকে হ্ত্যা করলে
বাংলার সব কটি মাটির প্রদীপে শিখা হয়ে ছড়িয়ে যাব
আমার বিনাশ নেই-
বছর বছর মাটির মধ্য হতে সবুজ আশ্বাস হয়ে ফিরে আসব
আমার বিনাশ নেই-
সুখে থাকব, দুঃখে থাকব সন্তান-জন্মে সৎকারে
বাংলাদেশ যতদিন থাকবে ততদিন
মানুষ যতদিন থাকবে ততদিন।

গদ্য- তৃষ্ণা বসাক






কুয়াশা যখন

ছোটবেলার নানান বিভীষিকার অন্যতম ছিল কুজ্ঝটিকা বানান। আমরা, যারা, বাক্সের বাইরে ভাবার জন্যে প্রসিদ্ধি পেয়েছিলাম,তাদেরই কেউ হয়তো বানিয়েছিল এর সন্ধিবিচ্ছেদ- ক+ু+ ঝটপট+ ট+ই+কা! তাতে অবশ্য পরীক্ষার খাতায় কোন সুফল মেলেনি, কিন্তু আমরা বিলক্ষণ বুঝে গিয়েছিলাম যে এই কুজ্ঝটিকা, যার ডাক নাম কুয়াশা, ভয়ঙ্কর গোলমেলে জিনিস। এর  কত কত বছর পরে দেখলাম কবি ও চিত্রকর শ্যামল জানা একটা আস্ত কবিতার বই লিখে ফেলেছেন- কুয়াশা নামক মেয়েটি।
‘তুমিতো সবটা, অর্ধেক যদি
আমি
পিছন ফিরেই কুয়াশার মত
নামি
কুয়াশা তোমার নাক-মুখ-চোখ
কই
আমি মেঘেদের আদরের মেয়ে
হই’ (কুয়াশা নামক মেয়েটি)
‘কুয়াশা-লাগা ভিন্ন দুটি হাতে সুরা নেমে এল
তারপর কী হল জানিনা! শুধু জানি
ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল একটি পলক

সেই ভাঙ্গাচোরা পলকের ভেতর দুজন
পাশাপাশি স্থির, বিবরণহীন দুটি পাথরের আগুন!’ (স্পর্শ)

চূর্ণ রোদ, ফোঁটা ফোঁটা মৃত্যু পড়ে আছে
অসময়ে কুয়াশা আসে, ঢাকে গাছ, ফুল নেই গাছে(একবিংশ শতাব্দী)
কেমন হাড় হিম হয়ে যায় এ কবিতার কাছে এলে। ওই যে ভাঙাচোরা পলকের ভেতর দুজন, পাশাপাশি স্থির, বিবরণহীন দুটি পাথরের আগুন’- এই ক্রম-বিচ্ছিন্নতা আমাদের গ্রাস করে। কখনো যে খুব খুব নৈকট্যেও কুয়াশা ঘনিয়ে আসে, দেখা যায় না পাশের মানুষকে- এ বুঝি সেই বিপন্নতার ছবি। অথচ এই কুয়াশা ভেঙ্গেই তো দেখা হয়েছিল অমিত লাবণ্যের।শিলং পাহাড়ের কুয়াশার আড়ালে লাবণ্য অমিতের প্রেম সঞ্চার ছদ্ম কুয়াশা সৃষ্টি করে ঋষি পরাশর মিলিত হয়েছিলেন ধীবরকন্যা সত্যবতীর সঙ্গে, জন্ম হয়েছিল কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের।
কবি যতই বলুন ‘তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা  করি উদ্ঘাটন সূর্যের মতন’ কিংবা ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ সিনেমায়  কুয়াশা কেটে কাঞ্চন জঙ্ঘা উঁকি মারার দৃশ্য যতই আইকনিক হোক না কেন,  আমরা কি সবসময় দেখতে চাই  সত্যের মুখ? বা দেখতে পারি? কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন যিনি বেদকে ভাগ করে বেদব্যাস নামে খ্যাতি পেলেন, তিনি নিজে কুয়াশার আড়ালে জন্মেছেন বলে, তাঁর সৃষ্ট প্রধান চরিত্রগুলির জন্মকথায় নিয়ে এলেন কুয়াশা। কর্ণ ও পঞ্চপাণ্ডব –কুন্তী ও মাদ্রীর এই ছ ছেলের জন্মই বেশ রহস্যাবৃত, তাদের প্রকৃত পিতার পরিচয় জানা যায় না। অগ্নিসম্ভবা দ্রৌপদীরও তাই। আর পুরুষোত্তম কৃষ্ণের জন্ম থেকে মৃত্যু - সমস্তটাই তো গাঢ় কুয়াশায় ঢাকা। 
কুয়াশার মধ্যে কোথাও যেন ছলনা রয়েছে।
‘তোমার সৃষ্টির জাল রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনাজালে
হে ছলনাময়ী’
এর বিপ্রতীপে আছে অন্তরের পথ, যা চিরস্বচ্ছ।
আর ছলনার আর এক নাম যে নারী তা তো পুরুষ কবিরা বলে বলে হদ্দ হয়ে গেছেন।
পুরুষের চোখে নারী কি খুব রহস্যময়ী? কিছুই স্পষ্ট করে বোঝা যায় না?
‘বুঝতে নারি নারী কী চায়, কী চায় গো?
মাঝখানে ছেদ কইতে কথা
চাইতে চাইতে মুদে পাতা
হাসতে হাসতে কেঁদে ফেলে
আসতে কাছে ফিরে যায়’

কুয়াশা এবং নারী-দুয়েরি যে রহস্যম্যতা আছে তা প্রথম বোঝে বাংলা সিরিয়াল। একটা সিরিয়াল হত তার নাম কুয়াশা যখন। বাংলা মেগাসিরিয়ালের আদি যুগে প্রথম দৃশ্যে কুয়াশার বুক চিরে যাওয়া একটা গাড়ির হেডলাইট।   লোকে খুব দেখত টি আর পি বেড়েই চলছিল। কারণ শেষ দৃশ্যে একটা ফোন আসত। একটা মেয়ে ফোন করত কাহিনীর মুখ্য পুরুষ চরিত্রটিকে। তিনি বলতে থাকতেন ‘কে? কে? ‘ অমনি সবাইকে আকণ্ঠ কৌতূহলে রেখে সিরিয়ালটি শেষ হয়ে যেত। বরাবরই পাশের ঘর থেকে শুনেছি, তাই আমার সিরিয়ালটির ল্যাজা মুড়ো কিছুই জানা হয়নি, কিন্তু আমিও বেজায় কৌতূহলী হয়ে পড়ছিলাম। তার নিরসন ঘটল, বহু বছর পরে যখন একটি স্বল্পায়ু পত্রিকায় বাংলা সিরিয়াল নিয়ে একটি চমৎকার ধারাবাহিক বেরোতে শুরু হল। তাতে ওই চিত্রনাট্যকারকে প্রশ্ন করা হয়েছিল- কে ফোন করত বলুন তো? সিরিয়াল শেষ হয়ে গেল তবু জানতে পারল না কেউ’ তিনি এর যা উত্তরে বলেছিলেন তা অতীব ব্যঞ্জনাময়,
‘বিশ্বাস করুন আমি নিজেও জানি না কে ফোন করত। আমাকে বলা হয়েছিল সাস্পেন্স ধরে রাখতে হবে, নইলে টি আর পি পড়ে যাবে’ বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, আমি, আপনি, আমরা জীবনের টি আর পি বাড়াবার জন্যে মাঝে মাঝেই কি এমন কুয়াশা তৈরি করি না নিজেদের চারপাশে?  সেই যে কেতকী কুশারী ডাইসনের ‘নোটন নোটন পায়রাগুলি’তে আছে গৃহবধূরা কিটি পার্টি, বাগান করা- আরও কত কুজ্ঝটিকা তৈরি করে রাখে নিজেদের চারপাশে, নোটন দাশকে দিয়ে সেসব হচ্ছে না। কুয়াশা তৈরি করতে না পারাও কিন্তু একটা অক্ষমতা। আর যাই হোক, দিল্লির ধোঁয়াশার চাইতে কুয়াশা হাজার গুণ ভালো, তাই না?



প্রবন্ধ- শ্রীজাতা গুপ্ত






মনের কুয়াশা কুয়াশার মন

মাধ্যমিকের টেস্ট পেপার নিয়ে বসতাম রাত ১১টার পর তখন নভেম্বর মাস পড়ে গেছে ডিসেম্বর-ও হতে পারে মোটমাট, আমাদের মফস্বলে কুয়াশা নেমে আসছে সন্ধ্যার আগেই, এমন একটা সময় এইটুকুই মনে রাখা জরুরি পড়ার টেবিলের সামনের জানলা সামান্য ফাঁক করে রাখতাম, নইলে আমার ক্লস্ট্রোফোবিয়া চেপে বসবে বুকে হাউজিঙ-এর মাঠ থেকে ভেসে আসত চাপা উত্তেজনা, ব্যাডমিনোন র‍্যাকেটে প্রিং-প্রিং ফেদার আদানপ্রদান এর মধ্যে রামকৃষ্ণ মিশনের ১৯৯৯ সালের অঙ্কের প্রশ্নপত্র খুলে বসতেই কানে আসত মিহি সুরে শিসদূর থেকে ক্রমশ কাছে আসতে থাকা 'এই রাত তোমার আমার' নিখুঁত বাবুয়াদাদা বড় রাস্তার আড্ডা শেষ করে হাউজিঙ-এর ক্যাম্পাসে ঢুকলো রোজ রাতে এই একই গানের শিস দিতেদিতে এক আড্ডা থেকে পরের আড্ডা পেরিয়ে দু'রাউন্ড ব্যাডমিন্টন পিটিয়ে ঘরে ফেরে বাবুয়াদাদা আমাদের ফ্ল্যাটের সামনের টিউবওয়েল এর কাছাকাছি যখন চলে আসে 'এই রাত তোমার আমার', আমি একবার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই বি-৫/৬ এর বারান্দায় শিরশিরে হাওয়া দেয় ল্যাম্পপোস্টের আলোর প্রেক্ষাপটে ভেসে বেড়ায় এলোমেলো কুয়াশার স্তর তার মধ্যে ঢুকে পড়ছে এই গান তার মধ্যে ঢুকে পড়ছে হ্যালোজেন গ্যাসবাতির ডিমের কুসুম রঙের আলো এই প্রথম আমি নাক টেনে টের পাচ্ছি কুয়াশার ঘ্রাণ ভেজা, সোঁদা, শান্ত ক্লস্ট্রোফোবিয়া থেকে পালিয়ে যাওয়ার নির্ভার ঘ্রাণ বাবুয়াদাদা তখন বেকার যুবক, অ্যাংরি ইয়াং ম্যান আমাদের থেকে অনেক বড় চাকরির পরীক্ষা দেয় এসব কথা বাবুয়াদাদাকে বলার সাহস হয়নি বললেই, “পাকামো করিস নাবলে ধ্যাতানি ছাড়া কিছুই জুটবে না কপালে তবু, বাবুয়াদাদার কাছে আমার ঋণ, সে আমাকে কুয়াশা দেখতে শিখিয়েছে একটি ডিকন্সট্রাক্টেড ফেনোমেনন এর মধ্যে কীভাবে একে একে ফিসিক্যাল প্রপার্টি যোগ হয়ে অশরীরী শরীর পায়, শিখিয়েছে গানের শিস, হলুদ আলো আর মফস্বলের হেমন্ত অথচ, কেমিস্ট্রি বই বলেছে, বাষ্পের রঙ নেই, রূপ নেই, ঘ্রাণ নেই কোনও আমার মস্তিষ্কে যে সেই কোন আদ্যিকালের রাতে তৈরী হয়েছিল নিউরাল কানেকশন, কুয়াশার স্মৃতি- অ্যাবস্ট্র‍্যাক্ট জলীয় আবহাওয়ার সম্পত্তি হয়ে উঠছিল আমার আজীবনের সম্পদ, তার কথা লেখা থাকবে কোন বইতে? হয়ত ঠিক এভাবেই ব্রেইনের বিভিন্ন পর্যায়ে বা স্তরে ঘটতে থাকা নিউরাল কানেকশান ভেসে ওঠে কুয়াশার মত বিভিন্ন ঘনাঙ্কের ইলেক্ট্রিক ঢেউ মিলেমিশে তৈরী হয় এমন একটি বস্তু, যাকে আমরা দেখতে পাইনা, ছুঁতে পারিনা বইতে তার সম্পর্কে লেখা থাকে, 'এর কোনও আকার নেই' হয়ত এইভাবেই ইমার্জেন্ট প্রপার্টির মত গড়ে ওঠে আমাদের মন মনের কুয়াশা

ঘুমিয়ে পড়ার পর এক ধরণের কুয়াশা ওঠে মাথার ভিতর ২৫ বছর আগে, অথবা এই গতকাল, তৈরী হয়েছিল যেসব স্মৃতি, তাদের থেকে ধার করা হয় কিছু ছবি, কিছু কথা হয়ত বা কিছু রঙও, ঠাহর হয়না এইসব একে একে ভেসে ওঠে ঘুমন্ত চোখের আড়ালে পাতলা কুয়াশার মত ভোরের আলো ফোটার মুহুর্তে শূন্য ধানক্ষেতের উপর যেমন জুবুথুবু হয়ে থাকে কাঁপা কাঁপা দুধের সর বাতাস অথবা, দুপুর বারোটার গীর্জার ঘন্টা পড়া মাত্র যেমন পাহাড়, পাকদন্ডী, ধুপি গাছের জঙ্গল আর গুম্ফার আনাচকানাচ থেকে গুলগুল করে বেড়িয়ে আসে উত্তরবঙ্গীয় কুহেলিকা সানুতল থেকে দেখলে তাকে মনে হবে অনেক দূরের মেঘ, পাহাড়ের কাছাকাছি বসলে সে ঘরের মেয়ে কুয়াশা যেমন, জেগে থাকলে এক একটি স্মৃতি অনেক কাল আগের, ঘুমের মধ্যে, সে তো ঘটছে এই, এইমাত্র অদ্ভূত এক টাইমল্যাপ্স নিমেষের মধ্যে ঘটিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখি এইসব মুহূর্তে অবচেতনে স্মৃতিদের ভেসে ওঠা মাখামাখি ভালোবাসার কুজ্ঝটিকায় মাথার ভেতরে কি তাহলে সবসময়েই শীতকাল? নাকি হেমন্ত? হেমন্তের কুয়াশায় অবশ্যই স্বপ্নময়তা বেশি, মায়া আরও গভীর হেমন্তের কুয়াশায় জীবনান্দ দাঁড়িয়ে থাকেন পৌষের পূর্বাভাসের মতন শীতল শান্ত ঘুমের এইখানেই প্রয়োজনীয়তা ঘুমের অগোচরে একে একে বাঁধা হয় সেতু পুরোনো স্মৃতিদের সঙ্গে নতুন স্মৃতিদের দেখা হওয়ার সেতু জাগরণে যাদের দেখা হওয়ার সম্ভাবনাই নেই কোনও বিচ্ছিন্ন দুই ভালোবাসার মানুষের র‍্যাপিড আই মুভমেন্ট ঘুমের দোলাচলে এক অনামী ঝুলন্ত সেতুর মাঝবরাবর মিলন দৃশ্য স্পষ্ট ঝকঝকে পাহাড়ের আকাশের মতন কুয়াশা তাহলে সবসময়ে ঝাপসা নয় অনিশ্চয়তাই তার একমাত্র ভবিতব্য নয় ল্যান্ডস্কেপ চিত্রে যেমন সামান্য জলরঙ ব্রাশস্ট্রোকে ঘেঁটে যাওয়া কুয়াশাচ্ছন্ন জায়গাটুকুই ক্যানভাসকে বসিয়ে দেয় পরিচিত মানচিত্রে ঠিক ঠিক! কার্সেওঙের কুয়াশার মত না? অথবা লখ-লুবনাইগ যাওয়ার পথে যেমন জলের বুক জড়িয়ে ছিল সর্পিল মিহি কুয়াশা এ তো সেখানকার পাহাড় মোটেও অ্যাল্পস-এর পাহাড় আঁকা হয়নি সেখানে কুয়াশা ছিল আরও ঘন এই স্ট্রোকে সামান্য টাইট্যানিয়াম হোয়াইট আর ক্যালিয়েন্তে গ্রে মেশালে তবে তা অস্ট্রিয়ান অ্যাল্পস হয়ে উঠত শুধু জল আর ফ্ল্যাট ব্রাশে এই কুয়াশা স্বপ্নেও সম্ভব নয় এই স্পষ্টবক্তা কুয়াশার দেখা পাওয়া যায় কেবল নিশ্চল ঘুমের ভেতর ঠিক যদি এই সময়ে চোখের উপর আলো এসে পড়ে, নড়বড়ে সাঁকো ছিঁড়ে যায় তার উপর দাঁড়িয়ে থাকা স্মৃতিরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে এদিক ওদিক অনেক উঁচু থেকে ফ্রি-ফল পেরিয়ে আছড়ে পড়ে দূরে নীচে নিঃশব্দে গড়িয়ে যাওয়া ফিনফিনে নদীর পাথুরে চরে থেঁৎলে যায় স্মৃতির অবয়ব নিরুদ্দেশের তালিকায় নথিভূক্ত হয় তাদের নাম কোনও উদ্ধারবাহিনী তাদের খোঁজ পায়না আর কোনওদিন বিশেষ বিশেষ খবরে দুর্ঘটনার ঘোষণার মত ঘুম ভেঙে বলতে হয়, “কী যেন একটা দেখছিলাম স্বপ্নে, হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলএই হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়ার আগের মুহূর্তে মস্তিষ্কে স্নায়ুদের মধ্যে যে নতুন সেতু গড়ে উঠছিল, যা আমাদের ঘুম ভাঙার পরের সবরকম ভাবনাচিন্তার ভিত্তি,  স্বাভাবিকভাবে কার্যরত থাকার মূল্যবান রসদ, তাও ভাঙা পড়ল গড়ে ওঠার আগেই

একটা স্বপ্ন দেখে ভয় পাই খুব বারবার ফিরে আসে একই স্বপ্ন প্রতিবার একইরকম ভয় পাই মা, বাবাকে জিজ্ঞেস করছেন, “এই মেয়েটা সারাক্ষণ আমার আসেপাশে ঘুরঘুর করে কেন? ওর নিজের বাড়ীঘর নেইএই কথা শুনে আমি ঘর থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছি কামেরা জুম-ইন  করছে আমার মুখের উপর, পিছন দিকে আউট অফ ফোকাস হয়ে যাচ্ছেন পাশাপাশি আরাম কেদারায় বসে থাকা মা বাবা আমার মুখে যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট স্বপ্নে, এবং স্বপ্নের থেকে বেরোনোর পরেও আমি ভাবি, সবচেয়ে কষ্ট পেলাম কিসে? মা আমাকে ভুলে গেছেন বলে? নাকি বাবাকে মনে রেখেছেন বলে মনের মধ্যে, বা মাথার মধ্যে যে স্মৃতি তৈরী হয়, তা কখনও কখনও ঢাকাও পড়ে যায় ঘন কুয়াশায় তখন সামনে কেবল ধূসর কোথায় জল শুরু হয়েছে, কোথায় আকাশ, তার মধ্যে কোনও দিগন্তরেখা চোখে পড়েনা অনন্ত শূন্যতার সামনে দাঁড়িয়ে আমরা মনে করার চেষ্টা করি এর আগে কী ছিল এর পরেই বা কী হওয়ার কথা এর ফাঁকে বাতাসে সামান্য দোলা উঠলে হঠাৎ চোখে পড়ে আবছা দূরগামী জাহাজ তাকে তখন কোথায় বসাবো আমরা? তার নীচে যে অতল সমুদ্র, তার মাথার উপরে অসীম আকাশ, তাকে ঘিরে রয়েছে শক্তপোক্ত স্থলভূমি, এসব তখন কুয়াশার কবলে আমরা তাই জাহাজকে বসিয়ে রাখি কাচের বোতলে, যেখানে কুয়াশার প্রকোপ হয়ত কিছুটা কম জানলার গায়ে কোহরা জমে জমে ঘষা কাচ দিয়ে দেখা পৃথিবীর মত অস্পষ্ট হতে থাকে চারপাশ এর মধ্যে দু'এক ফোঁটা বৃষ্টি জানলা বেয়ে নেমে এলে কিছুটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে সরু সরু দাগ সেখানে পরিষ্কার দেখা যায় ওপাশের বাড়ীর সিকিভাগ চিমনি, চিলেকোঠার রোদে গা এলানো পড়শির হুলো বেড়াল, ভ্যাটিকানের সূর্যাস্ত, ছোটবেলার পেন্সিল বাক্স পাশাপাশি কোলাজের মত এইসব টুকরো বসিয়ে কিছুতেই অর্থপূর্ণ মঞ্চ সৃষ্টি হয়না নৈনিতালের পথে হাঁ করে ভেসে বেড়ানো কুয়াশা খেতে চেয়ে বারবার ফসকে যাওয়ার বিফলতায় স্মৃতিরা পালিয়ে যেতে থাকে নাগালের বাইরে চেনা ট্রেকিং পথে অনেক বছর বাদে ফিরে গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়াতে হয় রুটম্যাপ যদিও বলছে এখানে একটা এবড়োখেবড়ো পথ উঠে যাবে রডোডেন্ড্রন ঝোপের মধ্যে দিয়ে, সামনে তখন রাস্তা আটকে দাঁড়িয়েছে রোম্যান্টিক জলীয় বাষ্পের ঘনঘোর এরপরে তো কিছুই নেই রুটম্যাপের উপর ভরসা করে এগিয়ে যাওয়ার সাহসটুকুও নেই স কিছুকে তুচ্ছ করে ঘিরে ধরছে গভীর খাদ আর, ক্ষণিকের বর্তমানটুকু আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে আমার মত দেখতে একটা দ্বীপ ততদিনে আমরা ভুলে গেছি র‍্যুম্যাপ কাকে বলে বৃষ্টি মানে কী? কুয়াশা, তার কী কোনও অর্থ রয়েছে আমার ভাষায় সেই কোনকালে তৈরী হওয়া কুয়াশার হলুদ রঙ, স্বতঃস্ফূর্ত ঘ্রাণ, 'এই রাত তোমার আমার', সব ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে অভূতপূর্ব শীতকালে ডিমেনশিয়ায় অ্যালঝাইমার্সে দু'দিকের শহর, পাহাড়, গ্রাম, নদীর পাড়ের মধ্যে বেড়ে যাচ্ছে দূরত্ব যেখানে এককালে পারাপার করত মানুষ যেখানে লোহালক্কর পাথর কেটে তৈরী হয়েছিল প্রাচীন সেতুপথ সেখানে এই মরশুমে দেখা যায়না কিছুই যোগাযোগবিহীন ধ্বংসস্তূপের মত ভেসে বেড়ায় স্মৃতি রোদ উঠে কুয়াশা কেটে যাওয়ার ক্ষীণ অপেক্ষায় যার ওপারে আবার হয়ত কোনওদিন দেখা যাবে পূর্বের কাঞ্চনজঙ্ঘা

একনজরে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না  যে পিতা সন্তানের লাশ সনাক্ত করতে ভয় পায় আমি তাকে ঘৃণা করি- যে ভাই এখনও নির্লজ্জ স্বাভাবিক হ...

পাঠক-প্রিয়